কলকাতা: দুরন্ত মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও সমতা আনে তারা। কিন্তু শেষে রক্ষণের ভুলে গোল খেয়ে হারতে হল ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে (East Bengal FC)। নতুন বছরের প্রথম ম্যাচে জয়ে ফেরার চ্যালেঞ্জ ছিল দুই দলের সামনেই। শেষ দিকের গোলে বাজি জিতে নেয় গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। ৩-২-এ জিতে পয়েন্ট টেবলে সেরা পাঁচের মধ্যে চলে এল তারা।


প্রথমার্ধে দু’গোল হজম করার পর দ্বিতীয়ার্ধে যে ভাবে মেজাজ বদলে খেলায় ফিরে আসে লাল-হলুদ বাহিনী, যে ভাবে দু’গোল করে মুম্বইকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, তার পরে সাগর পাড়ের দলের এই জয়কে ভাগ্যদেবীর দান বলাই যায়।


এ দিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে প্রথমার্ধ যদি হয় মুম্বই সিটি এফসি-র, তা হলে দ্বিতীয়ার্ধ অবশ্যই ইস্টবেঙ্গলের। প্রথমার্ধের প্রায় পুরোটাই কোণঠাসা হয়ে থাকার পর শেষ দিকে মাত্র চার মিনিটের মধ্যে পরপর দু’গোল (৩৯ মিনিটে লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে ও ৪৩ মিনিটে নিকোলাওস কারেলিস) খেয়ে হতাশায় ভেঙে পড়ার কথা যে দলের, দ্বিতীয়ার্ধে সেই ইস্টবেঙ্গলের অভাবনীয় লড়াই দেখা যায়।


পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে যে ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তারা, এ দিনও সে ভাবেই ঘুরে দাঁড়ায় তারা এবং ৬৬ মিনিটের মাথায় সাহিল পানওয়ারের নিজ গোল ও ৮৩ মিনিটের মাথায় ডেভিড লালনসাঙ্গার গোলে সমতা এনে ফেলে তারা। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে গ্রিক ফরোয়ার্ড কারেলিসকে আটকাতে না পারার মাশুল দিতে হয় ইস্টবেঙ্গল রক্ষণকে। যে ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারত তারা, সেই ম্যাচ খালি হাতে শেষ করতে হয় তাদের।


তবে মশাল-বাহিনী এদিন হেরে গেলেও তাদের এই তুমুল লড়াইয়ে বোঝা গিয়েছে, আগামী শনিবারের কলকাতা ডার্বি তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কাছে সম্ভবত খুবই কঠিন হতে চলেছে। সেই ম্যাচেও ইস্টবেঙ্গলকে এই আগুনে মেজাজে পাওয়া গেলে বড় ম্যাচের চিরকালীন আমেজ যে আরও একবার ফিরে আসবে, এই নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।


এ দিন শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় ইস্টবেঙ্গল এফসি। দুই প্রান্ত দিয়ে বারবার আক্রমণে উঠেও মুম্বইয়ের দুর্ভেদ্য রক্ষণে বারবার আটকে যান পিভি বিষ্ণু, নন্দকুমার শেকর, দিয়ামান্তাকসরা। প্রথম ১৫ মিনিটে ফাইনাল থার্ডে তারা ১১ বার প্রবেশ করলেও বক্সের মধ্যে তাদের একবারও বল ধরতে দেননি তিরি, মেহতাবরা।


অন্য দিকে, মুম্বইয়ের দুই উইং দিয়ে বিপিন সিং, বিক্রম প্রতাপ সিংদের অনবরত আক্রমণ লাল-হলুদ ডিফেন্ডারদের হিমশিম খাইয়ে দেয়। তবে প্রভাত লাকরা, লালচুঙনুঙ্গারা যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। মাঝমাঠে আহত শৌভিকের জায়গা ফের এ দিন নেন আনোয়ার আলি।


ইস্টবেঙ্গলের দুই সেন্টার ব্যাক হেক্টর ইউস্তে ও হিজাজি মাহেরকেও এ দিন কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, নিকোলাওস কারেলিসরা। ২৮ মিনিটের মাথায় প্রায় অবধারিত গোল বাঁচান ইউস্তে। বক্সের মধ্যে উড়ে আসা বল হেড করে গোলের সামনে কারেলিসের কাছে পাঠান তিরি। ছ’গজের বক্সের মধ্যে থেকে নেওয়া কারেলিসের হেড গোললাইনে ব্লক করেন ইউস্তে।


ম্যাচের ৩৩ মিনিটের মাথায় বক্সের মধ্যে থেকে বিপিনের কোণাকুনি শট গোলে ঢোকার আগেই আটকে দেন প্রভসুখন গিল। ৩৬ মিনিটের মাথায় বক্সের মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোলের সুযোগ পেয়েও গিলের তৎপরতায় ব্যর্থ হন ছাঙতে। তবে ৩৯ মিনিটের মাথায় ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ ছাঙতেকে যে গোলের পাস বাড়ান, সেই সুযোগ দুর্দান্ত ভাবে কাজে লাগিয়ে নেন তিনি।


বক্সের দিকে যে পাস বাড়ান ব্র্যান্ডন, তা নিয়ে বক্সে ঢুকে গিলকে পরাস্ত করে দূরের পোস্টের দিকে ঠেলেন ছাঙতে, যা পোস্টে লেগে গোলে ঢুকে যায় (১-০)। তাঁকে পাহাড়ায় রেখেও আটকাতে পারেননি লালচুঙনুঙ্গা। এ দিন মাঝমাঠ থেকে বারবার আক্রমণে ওঠেন ছাঙতে। যার ফলে লাল-হলুদ ডিফেন্ডাররা তাঁকে সর্বক্ষণ ম্যান মার্কিংয়ে রাখতে পারেননি। এই সুযোগই কাজে লাগিয়ে নেন ভারতীয় দলের তারকা।


প্রতিপক্ষের রক্ষণে ফাটল ধরানোর পর সেই ফাটল দিয়ে মাত্র চার মিনিটের মধ্যেই ফের গোল করে মুম্বই। মাঝমাঠ পেরিয়ে ক্লেটন সিলভাকে ধোঁকা দিয়ে বক্সের মধ্যে বল পাঠান ইওল ফান নিফ, যেখানে ছিলেন কারেলিস। তাঁর সঙ্গে লেগে থেকেও গতিতে পেরে ওঠেননি ইউস্তে। বক্সে ঢুকে কারেলিস শট নেন, যা প্রথমে আটকে দেন গিল। কিন্তু তাঁর হাত থেকে বল ছিটকে আসে এবং ফিরতি বল জালে জড়িয়ে দেন গ্রিক ফরোয়ার্ড (২-০)। প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে ছ’বারের বেশি পা লাগাতে পারেননি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা। তারা মাত্র একটি শট গোলে রাখে। সেখানে মুম্বইয়ের পাঁচটি শট ছিল লক্ষ্যে।


দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণাত্মক মেজাজ ছিল অবাক করার মতো। নন্দকুমারের জায়গায় নাওরেম মহেশ ও প্রভাত লাকরার জায়গায় নিশু কুমারকে নামিয়ে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে লাল-হলুদ বাহিনী। বেশিরভাগ বল নিজেদের দখলে রেখে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে রাখার প্রবণতাও দেখা যায় তাদের পারফরম্যান্সে।


বক্সের বাইরে থেকে জোরালো, মাপা দূরপাল্লার শট নিতে অভ্যস্ত জিকসন সিং এ দিনও ম্যাচের ৫১ মিনিটের মাথায় সে রকমই এক শট নেন, যা বারের কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর পরেই বক্সের মধ্যে ক্লেটনের দেওয়া ক্রসে গোলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই বল ধরার মতো কেউ ছিল না।


মুম্বই ব্যবধান বাড়ানোর আরও একটি অনবদ্য সুযোগ পেয়ে যায় ৫৬ মিনিটের মাথায়, যখন মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে সোজা বক্সে ঢুকে গোলে শট নেন কারেলিস। কিন্তু গোলকিপার গিলের দুরন্ত ক্ষিপ্রতার জন্য এ বার বেঁচে যায় হোম টিম। তবে ইস্টবেঙ্গল চেষ্টা চালিয়ে যায়। এর আগেও পাঞ্জাব এফসি-র মতো দলের বিরুদ্ধে দু’গোলে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ম্যাচ জিতেছে তারা। সেই ম্যাচের কথা নিশ্চয়ই মাথায় ছিল তাদের।


ক্রমশ চাপ বাড়াতে থাকে লাল-হলুদ বাহিনী এবং ৬৬ মিনিটের মাথায় সফলও হয় তারা। বাঁ দিক দিয়ে ওঠা মহেশের শট প্রথমে গোলকিপার টিপি রেহনেশের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে, যা বিষ্ণুর পায়ে এসে পড়ে। তিনি কাট ব্যাক করে গোলের সামনে বল পাঠান। কিন্তু তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজের গোলের জালেই জড়িয়ে দেন ডিফেন্ডার সাহিল পানওয়ার (২-১)।


সমতা আনার জন্য আক্রমণে লোক বাড়াতে এই গোলের পরেই জিকসনের জায়গায় ডেভিড লালনসাঙ্গাকে মাঠে নামায় ইস্টবেঙ্গল। এই সময় ছকও বদলে ফেলে তারা। যাতে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মাঠে নামার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বক্সের মধ্যে থেকে গোলে শট নেন ডেভিড, কিন্তু তা গোলে পৌঁছয়নি।


অশনি সঙ্কেত দেখতে পেয়ে রক্ষণে শক্তি বাড়াতে এই সময় দুই ডিফেন্ডার থায়ের ক্রুমা ও নাথান রড্রিগেজকে নামায় মুম্বই। কিন্তু তাঁরা মাঠে নেমে থিতু হওয়ার আগেই সমতা এনে ফেলেন ডেভিড। ৮৩ মিনিটের মাথায় অসাধারণ গোল করেন তরুণ ফরোয়ার্ড। ৮২ মিনিটের মাথায় কঠিন কোণ থেকে নেওয়া দিয়ামান্তাকসের গোলমুখী শট রেহনেশ বিপন্মুক্ত করার পর কর্নার পায় ইস্টবেঙ্গল।


এই কর্নারের পর বল বক্সের বাইরে চলে আসে এবং লালচুঙনুঙ্গার ভলি বক্সের সামনে গিয়ে পড়লে তা হেড করে গোলের ডানদিকে ডেভিডের কাছে পাঠান ইউস্তে। প্রথম টাচেই দূরের পোস্টের দিক দিয়ে বল গোলে পাঠান ডেভিড, যা ছিল নিখুঁত মাপা শট (২-২)।


কিন্তু গোলের জন্য মরিয়া ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে অনেক ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়ে যায়। সেই ফাঁকা জায়গাই কাজে লাগিয়ে চার মিনিটের মধ্যে ফের ব্যবধান তৈরি করে নেন কারেলিস। মাঝমাঠ থেকে তাঁকে থ্রু বাড়ান রড্রিগেজ। তিনি বল নিয়ে বক্সের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আনোয়ার আলি তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে মাঠে লুটিয়ে পড়েন। হিজাজি মাহেরও তাঁকে আটকাতে যান। কিন্তু তাঁকে পরোয়া না করে বক্সে ঢুকে এগিয়ে আসা গিলের পাস দিয়ে গোলে বল ঠেলে দেন গ্রিক ফরোয়ার্ড (৩-২)। যুবভারতীর গ্যালারিতে শুরু হওয়া উৎসব এই গোলের সঙ্গে সঙ্গেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।


ছ’মিনিটের সংযুক্ত সময়েও সমতা আনার সুযোগ এসেছিল ইস্টবেঙ্গলের সামনে। কিন্তু দিয়ামান্তাকসের গোলমুখী শট দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় সেভ করেন রেহনেশ। ওই গোলটি পেলে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারত ইস্টবেঙ্গল।


ইস্টবেঙ্গল এফসি দল (৪-৪-২): প্রভসুখন সিং গিল (গোল), প্রভাত লাকরা (নিশু কুমার-৪৫), হেক্টর ইউস্তে, হিজাজি মাহের, লালচুঙনুঙ্গা, নন্দকুমার শেকর (নাওরেম মহেশ-৪৫), আনোয়ার আলি (শৌভিক চক্রবর্তী-৯২), জিকসন সিং (ডেভিড লালনসাঙ্গা-৬৯), পিভি বিষ্ণু, ক্লেটন সিলভা, দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। (সৌ: আইএসএল মিডিয়া)


আরও পড়ুন: তাঁর হাত ধরেই দৌড় শুরু চাকদহ এক্সপ্রেসের, প্রয়াত স্বপ্নন সাধু, শোকে বিহ্বল কিংবদন্তি ঝুলন