কলকাতা: মাঠে ব্যাট হাতে ছক্কা মারেন। এক ওভারে ঘুরিয়ে দেন ম্যাচের মোড়। বল হাতে উইকেট নেন। ফিল্ডিংয়ে অবিশ্বাস্য সমস্ত ক্যাচ নেওয়ার পাশাপাশি অভ্রান্ত নিশানায় ভেঙে দেন স্টাম্পস। তাঁর নির্মম পেশাদারিত্ব আর ক্রিকেটীয় দক্ষতা দেখে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক পর্যন্ত বলে ফেলেন, 'ও একাই আমাদের হারিয়ে দিল।'


মাঠের বাইরে সেই তিনিই আবার মানবিকতার অন্যতম উদাহরণ। করোনা পরিস্থিতিতে কখনও অভাবী মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ্যসামগ্রী। করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে অক্সিজেনের জোগান, সবরকম ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। কখনও আবার রাজকোটে নিজের বন্ধ থাকা রেস্তোরাঁর কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন অর্থ। ব্যবসা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও। এবং পুরোটাই করছেন নীরবে। আর এই সমস্ত কাজে তাঁর ছায়াসঙ্গী দিদি নয়না।


তিনি রবীন্দ্র জাডেজা। জাতীয় দলের তারকা অলরাউন্ডার রবিবার আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসকে কার্যত একা হাতে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্য়াঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ম্যাচ জিতিয়েছেন। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য তাঁকেই ম্য়াচের সেরা বেছে নেওয়া হয়েছিল। সেই জয়ের রেশ কাটার আগেই সৌরাষ্ট্রের তারকা ক্রিকেটারের দিদি শোনালেন এক অজানা কাহিনি। রাজকোট থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে জাডেজার দিদি নয়না বললেন, 'লকডাউনের সময় রাজকোটের অনেক অভাবী মানুষের বাড়িতে রেশন পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। জাড্ডু (জাডেজার ডাকনাম) নিজে অবশ্য় যেত না। ওকে দেখলেই সর্বত্র ভিড় জমে যায়। তাই সব জায়গায় ও যেতে পারে না। আমরা এবং আমাদের টিম বাড়ি বাড়ি খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে এসেছে।'


করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতে। হাসপাতালে বেড নেই। পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই। ফের মুশকিল আসান জাডেজা ও নয়না। 'এবারের সমস্যাটা একটু আলাদা। মানুষ হয়তো কাজ করছেন। কিন্তু করোনা আক্রান্তরা চিকিৎসা করাতে পারছেন না। কোথাও বেড নেই। জীবনদায়ী অক্সিজেন বা ওষুধ নেই। খবর পেলেই আমরা সাধ্যমতো সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে অক্সিজেনের সুলুকসন্ধান, সবরকমভাবে পাশে থাকছি মানুষের,' ফোনে বলছিলেন নয়না।


রাজকোট শহরের বুকে রয়েছে জাডেজার বিশাল রেস্তোরাঁ 'জাড্ডুস ফুড ফিল্ড'। সারাবছর ক্রিকেটের ব্যস্ততার জন্য ব্যবসার দেখাশোনা করেন দিদি নয়নাই। তবে করোনার নতুন করে বাড়বাড়ন্তের জন্য আপাতত রেস্তোরাঁ বন্ধ রেখেছেন। নয়না বলছিলেন, 'রাজকোটে ফের নতুন করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে নাইট কার্ফু চলছে। রাত আটটা বাজলেই হোটেল-রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। কিন্তু আমাদের রেস্তোরাঁয় রাতেই ভিড় হয়। আটটার আগে কেউ কি আর ডিনার সারতে আসে! অগত্যা রেস্তোরাঁ বন্ধ রেখেছি।'


জাডেজার রেস্তোরাঁয় জনা ২৫ কর্মী রয়েছেন। তাঁদের বেশিরভাগই বাড়ি চলে গিয়েছেন। নয়না জানালেন, কারও বাড়ি উত্তরাখণ্ডে, কারও বাড়ি প্রতিবেশি দেশ নেপালে। তবে প্রত্যেকের কাছে সপ্তাহে সপ্তাহে মাইনের টাকা পৌঁছে দিচ্ছে জাডেজা পরিবার। রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকলেও। নেপালের বাসিন্দা ডিংটো যেমন ফোনে বললেন, 'এক সপ্তাহ হল আমি বাড়ি এসেছি। তবে মালিকপক্ষ আমাকে আগাম মাইনে দিয়ে দিয়েছেন। আশা করছি দ্রুত রাজকোটে ফিরতে পারব।' আর এক কর্মী হরিশ বললেন, 'আমিও পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে নেপাল এসেছি। ম্যাডাম সবরকম প্রয়োজনে পাশে থাকেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই ফিরে যাব।' রেস্তোরাঁর এক কর্মী গণেশ আবার বাড়ি ফেরেননি। বন্ধ রেস্তোরাঁতেই রয়ে গিয়েছেন। তিনি জানালেন, তাঁর সঙ্গেই থেকে গিয়েছেন আরও কয়েকজন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা করছেন তাঁরা। গণেশ জানালেন, সবরকম খাদ্যসামগ্রী কেনার অর্থসাহায্য করছেন জাডেজারাই।


নয়না রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। বলছিলেন, 'জাড্ডু এসব কাজকর্ম নিয়ে প্রচার একদম চায় না। যা করার নীরবেই করে।' ক্রিকেট মাঠে তাঁর ফর্ম দেখে উচ্ছ্বসিত নয়না। বললেন, 'অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে টেস্ট সিরিজে মিচেল স্টার্কের বলে বাঁহাতের আঙুলের হাড় সরে গেল। দেশে ফিরে অস্ত্রোপচার করাতে হয় জাড্ডুকে। সেই সময়টা খুব কঠিন ছিল। বেঙ্গালুরুতে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে গিয়ে রিহ্যাব করেছিল। তবে ফিটনেস ট্রেনিং বন্ধ করেনি। নিয়মিত জিম করেছে। সেই পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছে।' যোগ করলেন, 'অনেকে বলেছিলেন চেন্নাই সুপার কিংস বয়স্কদের দল। ওরা এবারও কিছু করতে পারবে না। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে দিয়েছে জাড্ডু ও ওর সতীর্থরা। আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার সিএসকে।'


মাঠের ফল কী হবে, সময়ই বলবে। তবে মাঠের বাইরে মন জিতে নিয়েছেন জাডেজা।


পরিবারে করোনার হানা, আইপিএল থেকে সরে দাঁড়ালেন অশ্বিন