সন্দীপ সরকার, কলকাতা: আইপিএলে (IPL 2025) তিনি খেলছেন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে। আর বল হাতে দলকে জিতিয়ে ম্যাচের রং পাল্টে দিচ্ছেন কেকেআরের (Kolkata Knight Riders) তরুণ তুর্কি বৈভব অরোরা (Vaibhav Arora)। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের (KKR vs SRH) ভয়ঙ্কর ব্যাটিং তাঁর বলে জব্দ হয়েছে। ট্র্যাভিস হেডের (Travis Head) বিরুদ্ধে ঈর্ষণীয় রেকর্ড। ডানহাতি পেসারকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বয়ং শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan)। ম্যাচের সেরার পুরস্কার পাওয়া পেসারের জন্য পাঠিয়েছেন বার্তা। হর্ষিত রানার (Harshit Rana) সঙ্গে তাঁর জুটিতে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে নাইটদের বোলিং। অজিঙ্ক রাহানে-বেঙ্কটেশ আইয়ারদের তুরুপের তাস একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন টিমহোটেলে বসে।


প্রশ্ন: ট্র্যাভিস হেড ভারতের আতঙ্ক। অস্ট্রেলীয় তারকাকে বল করার আগে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান ভারতীয় বোলাররা। আর আপনি ৩ বলে ২ বার আউট করেছেন! ফর্মুলাটা কী?


বৈভব অরোরা: (হেসে) ফর্মুলা আলাদা কিছু নয়। যেটা আমার শক্তি, সেটাই ট্র্যাভিস হেডের দুর্বলতা। আমি স্বাভাবিক বোলিংই করি। তাতেই ওর দুর্বলতা প্রকট হয়ে যায়। আমি নিজের দক্ষতা অনুযায়ী বল করি। আউট করানোর লোক তো ঈশ্বর। আমি শুধু বল করে যাই। উইকেট ঈশ্বর দেন।


প্রশ্ন: হর্ষিত রানা আর আপনার বল হাতে পার্টনারশিপ তো বিপক্ষ ব্যাটিংয়ের ত্রাস হয়ে উঠেছে। জুটিতে সাফল্যের রসায়ন কী?


বৈভব: আমি শুরু থেকে বল স্যুইং করাই। আর হর্ষিতের বলে বাড়তি গতি রয়েছে। সেই গতির সঙ্গে ও স্যুইং করায়। আমরা দুজনই আগ্রাসী বোলিং করি। দুজনই উইকেট তুলে নিতে পারি। আমাদের লক্ষ্য থাকে শুরুতেই যদি দুজনে অন্তত একটা করে উইকেট তুলে নিতে পারি, তাহলে বিপক্ষ জব্দ হয়ে যায়। আমাদের বোঝাপড়া দারুণ। আমার অস্ত্র স্যুইং। আর ওর অস্ত্র গতির সঙ্গে স্যুইং। আমাদের জুটি জমে গিয়েছে। আশা করছি এভাবেই পারফর্ম করব আর দলকে জেতাতে থাকব।


প্রশ্ন: আপনার এখনও পর্যন্ত ক্রিকেট সফর নিয়ে বলুন, খেলাটা শুরু কীভাবে?


বৈভব: আমাদের দেশে সব বাচ্চাই গলিতে খেলতে খেলতে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমারও সেটাই স্বপ্ন ছিল। আমার বাড়ি আম্বালায়। ২০১১ সালে তখন আমার ১৪ বছর বয়স। ক্রিকেট খেলার জন্যই সেখান থেকে চণ্ডীগড়ে চলে আসা। সেখান থেকেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। পরে হিমাচল প্রদেশের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা শুরু করি।


প্রশ্ন: একটা সময় তো আপনি ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেন?


বৈভব: সেটা বেশ কঠিন সময় ছিল। বাড়ির আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব মনে হচ্ছিল না। তখনই খেলা ছাড়ার কথা ভেবেছিলাম। সেই সময় আমার কোচ রবি কুমার বর্মা পাশে দাঁড়ান। হস্টেলে থাকার বন্দোবস্ত করেন। অ্যাকাডেমিতে আমাকে নিখরচায় প্র্যাক্টিসের ব্যবস্থা করেন। তখনই মনে হয় যে, চলো আমাকে এবার কিছু একটা করে দেখাতে হবে। আর্থিক চিন্তা কেটে যাওয়ার পর পরিশ্রম বাড়িয়ে দিই। ঠিক করি, আরও ২ বছর ক্রিকেটকে অর্পণ করি। তারপর দেখা যাবে। সৌভাগ্যবশত, সেই ২ বছরেই আমার সামনে দরজাগুলো একটা একটা করে খুলে যেতে শুরু করে।


প্রশ্ন: আপনার তো একবার গাড়ি দুর্ঘটনাও হয়েছিল, কীভাবে মাঠে ফিরলেন তারপর?


বৈভব: বড় কোনও দুর্ঘটনা হয়নি এই রক্ষে। আমি ও অর্শদীপ (পেসার অর্শদীপ সিংহ) বাইকে যাচ্ছিলাম। পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার ক্যাম্প ছিল সকালে। ভোরবেলা বেড়িয়েছিলাম। তবে ছোটখাট দুর্ঘটনা ছিল। খুব বড় কোনও ক্ষতি হয়নি। মাসখানেকের মধ্যেই মাঠে ফিরেছিলাম।


প্রশ্ন: হায়দরাবাদ ম্যাচের পর টিমমালিক শাহরুখ খান মেসেজ পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কতটা খুশি?


বৈভব: দলের মালিক এত বড় একজন তারকা। তাও মাটির মানুষ। ভীষণ সহৃদয়। সব সময় পাশে থাকেন। উৎসাহ দেন। উনিও কেরিয়ারের শুরু থেকে খুব লড়াই করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছেন। সেই কারণে সকলকে ভীষণ সমর্থন করেন। কারও সমালোচনা করেন না। খারাপ পারফরম্যান্স করলেও কোনওদিন বকাবকি করেন না। এরকম একজন মহাতারকা যখন পাশে দাঁড়িয়ে লাগাতার অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়, ভাল কিছু করার খিদেটা বেড়ে যায়। সব সময় বুঝিয়ে দেন, আমি আছি। চিন্তা নেই। ওঁর জন্য বাড়তি একটা তাগিদ তৈরি হয় সকলের মধ্যে। আমি ভাগ্যবান যে এরকম মালিক পেয়েছি।


প্রশ্ন: শাহরুখের সিনেমা দেখেন?


বৈভব: নিশ্চয়ই দেখি। শাহরুখ খানের সিনেমা দেখে না এরকম কেউ আছে নাকি!


প্রশ্ন: গত বছর মিচেল স্টার্কের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুমে ছিলেন। এবারও অনরিক নখিয়ার মতো আন্তর্জাতিক তারকা রয়েছেন। বোলিং কোচ হিসাবে ভরত অরুণকে পাচ্ছেন। কী শিখতে পারলেন?


বৈভব: মেন্টর হিসাবে ডি জে ব্র্যাভোকে পাচ্ছি আর বোলিং কোচ হিসাবে ভরত অরুণকে। দুজনই ভীষণ অভিজ্ঞ। জ্ঞানের ভাণ্ডার দুজনই। যতটা শিখে নিতে পারব, তত লাভ আমারই। ভরত স্যরের সঙ্গে এটা নিয়ে তিন বছর কাজ করছি। ওঁর অভিজ্ঞতা থেকে সব সময় বোলারদের কী করা উচিত বলতে থাকেন। আর ডিজে-র কাছে ডেথ বোলিং নিয়ে অনেক কিছু শিখছি। ডেথ বোলিংয়ে এত বছর ধরে আইপিএলে দাপট দেখিয়েছেন ডিজে স্যর। আমিও সেই পথে হাঁটতে চাই।


প্রশ্ন: টি-২০ ক্রিকেটকে মনে করা হয় ব্যাটারদের খেলা। সেই ফর্ম্যাটে বল করেন কী মানসিকতা নিয়ে?


বৈভব: আমি নতুন বলে বোলিং করি। ওভার প্রপতি রান খরচ করি কম। আমার কাজই হল উইকেট তোলা। উইকেটের জন্য ঝাঁপাই। আমি রান খেয়ে গেলেও চেষ্টা করি সার্কেলের মধ্যে কীভাবে ব্যাটারকে ঠকানো যায় আর আউট করা যায়।


প্রশ্ন: নতুন বলে, নাকি ডেথ ওভারে, কোথায় বল করতে বেশি স্বচ্ছন্দ?


বৈভব: দু’জায়গাতেই বোলিং করতে পছন্দ করি। নির্ভর করে ম্যাচের পরিস্থিতির ওপর। দুটোই সহজ, আবার দুটোই কঠিন। আমি দু’জায়গাতেই বল করতেই স্বচ্ছন্দ।


প্রশ্ন: শোয়েব আখতার থেকে শুরু করে উমর গুল, ব্রেট লি, শ্যেন বন্ড, মিচেল স্টার্ক – বিশ্বের তাবড় ফাস্টবোলাররা কেকেআরে খেলেছেন। এখন আপনি ও হর্ষিত খেলছেন। নাইটদের ফাস্টবোলিংয়ের পরম্পরাকে কীভাবে দেখেন?


বৈভব: আমরা এই দলে সুযোগ পেয়েছি বলে ভাগ্যবান মনে করি। আমার ও হর্ষিতের চেষ্টা এটাই থাকবে যে, পেস বোলিংয়ের এই সমৃদ্ধ পরম্পরা যেন সঠিকভাবে বয়ে নিয়ে যেতে পারি। আগামী কয়েক বছর যেন কেকেআরের হয়ে নিজেদের সেরাটা দিতে পারি।


প্রশ্ন: পেসারদের ট্রেনিং, ডায়েট নিয়ে অনেক কড়াকড়ি থাকে। কীরকম ডায়েট মেনে চলেন?


বৈভব: আমার ডায়েটের মূল মন্ত্র হল, ভাল করে খাও। মাঠে ভাল পারফরম্যান্স করতে হলে যা জরুরি। অস্বাস্থ্যকর কিছু খাই না। বেশি মিষ্টি খাই না। তেল যতটা সম্ভব কম। বিশেষ কিছুই নয়। সঙ্গে সঠিক ট্রেনিং। ফিট থাকলে তার ফল মাঠে দেখা যায়।


প্রশ্ন: কেকেআরে এটা নিয়ে আপনার তিন বছর। কলকাতার সঙ্গে যোগসূত্র কেমন তৈরি হল?


বৈভব: দারুণ কানেকশন। আমার আইপিএল সফর এই দলের হয়েই শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালে আমাকে নিয়েছিল কেকেআর। পরে ফের কেকেআরে ফিরি। প্রথম দলের প্রতি সব সময়ই একটা আলাদা আবেগ থাকে। কেকেআর আমার পরিবারের মতো। প্রত্যেক বছরই মনে হয় যেন নিজের বাড়িতে রয়েছি। নিজেদের পরিবারের অভাব টের পাই না।



প্রশ্ন: আর শহর কলকাতা, সেই অভিজ্ঞতা কেমন?


বৈভব: কলকাতাকে ভালবেসে ফেলেছি। এখানকার সমর্থকেরা দারুণ। ভীষণ উৎসাহ দেয়। দারুণ মানুষ। প্রাণ ভরে ভালবাসেন। আইপিএলের সময় খুব বেশি ঘোরাঘুরির সুযোগ হয় না। তার মাঝেও সময় বার করতে পারলেই শপিংয়ে চলে যাই। হানি সিংহের কনসার্টে গিয়েছিলাম। কলকাতার মানুষকে বলব, এভাবেই সমর্থন করে যান।


প্রশ্ন: ক্রিকেটের বাইরে আর কী পছন্দ করেন?


বৈভব: শপিং করতে ভালবাসি। সবাই শপিং পছন্দ করি। আমি, হর্ষিত, রামনদীপ, অঙ্গকৃষ মিলে শপিংয়ে বেরিয়ে পড়ি মাঝে মধ্যেই।


প্রশ্ন: আর কলকাতার খাওয়াদাওয়া?


বৈভব: আপনাদের মিষ্টি দই আর রসগোল্লা আমার ভীষণ প্রিয়। চিট ডে করলে, মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে হলেই কলকাতার মিষ্টি খাই।



প্রশ্ন: বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের কেমন লাগছে?


বৈভব: দারুণ। সমর্থকেরা আমাদের হয়ে গলা ফাটালে আলাদাই তাগিদ তৈরি হয়ে যায়। মাঠে নেমে নিজের একশো শতাংশ ছাপিয়ে যাই। গোটা গ্যালারিতে বেগুনি পতাকা দেখলেই চনমনে হয়ে যাই। মনে হয় সবটা উজাড় করে দিই।


প্রশ্ন: মহিলা অনুরাগীও তো বাড়ছে নিশ্চয়ই, সামলাচ্ছেন কীভাবে?


বৈভব: (হেসে) আলাদা করে কিছু খেয়াল করিনি। আমি আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব একটা থাকি না। কে কী মেসেজ করল অত দেখি না। পুরনো বন্ধুরাও এখনও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।


প্রশ্ন: আপনি নিজে খেলছেন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে। এই ভূমিকাটা নিয়ে কী উপলব্ধি?


বৈভব: ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মে প্রথমে বোলিং করলে পরে একজন অতিরিক্ত ব্যাটার নামানো যায়, প্রথমে ব্যাটিং করলে পরে বাড়তি বোলার নামানো যায়। আমি সব সময় তৈরি থাকি। প্রথম থেকেই জানি আমাকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের ভূমিকা পালন করতে হবে। শুরুতে ব্যাটিং করলে আমি বাইরে থেকে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি পিচ ও পরিবেশ কেমন।


প্রশ্ন: কেকেআর গতবারের চ্যাম্পিয়ন। বারবার যে আলোচনা হচ্ছে মুকুট রক্ষার লড়াই, এটা কতটা চ্যালেঞ্জিং?


বৈভব: চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। তবে আমাদের সুবিধা হল গত বছরের দলটা প্রায় ৯০ শতাংশ ধরে রাখা গিয়েছে। নিজেদের বোঝাপড়া ভাল। একে অপরকে চিনি, বুঝি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আশা করছি ট্রফি ধরে রাখতে পারব।


প্রশ্ন: প্রিয় ফাস্টবোলার কে?


বৈভব: আগে ডেল স্টেনের ভক্ত ছিলাম। ছোট থেকে স্টেনের বোলিং দেখে বড় হয়েছি। তবে এখন যশপ্রীত বুমরার বোলিং দারুণ লাগে। যে ফর্ম্যাটই হোক, ম্যাচের পরিবেশ-পরিস্থিতি যাই হোক, বুমরা যেভাবে দাপট দেয়, দেখে শেখার মতো।


প্রশ্ন: কেকেআরের সবচেয়ে বড় কাঁটা হতে পারে কোন দল?


বৈভব: সব দলই সমান। সব দলই শক্তিশালী। আইপিএলে সহজ ম্যাচ হয় না। ভাল ক্রিকেট খেললে সব দলকেই হারানো যায়, আর খারাপ খেললে যে কোনও দল হারিয়ে দিয়ে যেতে পারে।


প্রশ্ন: কোন ব্যাটারকে বল করার আগে একটু ভয় করে?


বৈভব: এমন কোনও ব্যাটার নেই। আমি শুধু ব্যাটার ধরে ধরে পরিকল্পনা করি। সেই পরিকল্পনা খেটে গেলে ভাল, না খাটলে প্ল্যান বি ভাবতে হয়।