কলকাতা: প্রায় প্রত্যেক দল নির্বাচনী বৈঠকের পর তাঁর সঙ্গী হতো হতাশা। মুখ নিচু করে, ধীর পায়ে সঞ্জু স্যামসন পৌঁছে যেতেন তিরুঅনন্তপুরমে মেডিক্যাল কলেজ গ্রাউন্ডে। শৈশবের কোচ বিজু জর্জের কাছে। সান্ত্বনার খোঁজে। প্রশ্ন করতেন, ‘আর কী করব?’ পিঠে আশ্বাসের হাত রাখতেন বিজু। ছাত্রের জন্য কোচের মন্ত্র ছিল, ‘লড়াই ছাড়লে চলবে না।’


আইপিএলে ব্যাট হাতে সেই সঞ্জুই বোলার-নিধন যজ্ঞ চালাচ্ছেন। দুই ম্যাচে তাঁর স্কোর? ৩২ বলে ৭৪ ও ৪২ বলে ৮৫! ২ ম্যাচে মোট রান ১৫৯। স্ট্রাইক রেট ২১৪.৮৬! দুই ম্যাচেরই সেরা। প্রতিপক্ষ বোলারদের তালিকায় কখনও লুনগি এনগিডি, কখনও মহম্মদ শামি। পরোয়া নেই কেরলের ২৫ বছরের তরুণের। বাইশ গজে ব্যাট হাতে দৃপ্ত শরীরী ভাষা। কঠিন চোখমুখ। শক্ত চোয়াল। দুই ইনিংসের ৫টি চার ও ১৬টি ছক্কার প্রত্যেকটিতে যেন ঠিকরে বেড়িয়েছে জেদ, হাল না ছাড়ার। আর জবাব, উপেক্ষার।



ত্রয়োদশ আইপিএলে ফের স্বমেজাজে সঞ্জু। যা দেখে খুশি বিজু। যিনি নিজেও আইপিএলের অঙ্গ। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ফিল্ডিং কোচ বিজু। এক সময় কলকাতা নাইট রাইডার্সের অন্যতম সাপোর্ট স্টাফ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সোমবার দুবাই থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দকে বিজু বললেন, ‘সঞ্জুর এই ফর্ম ক্রিকেটের পক্ষে দারুণ খবর। ও, কে এল রাহুল, ময়ঙ্ক অগ্রবাল, শুবমান গিলরাই তো ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ।’



কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার (সাই) মেডিক্যাল কলেজ গ্রাউন্ডে সঞ্জুকে ১১ বছর বয়সে প্রথম দেখেন বিজু। সেখানেই শুরু হয় তাঁর ক্রিকেট সাধনা। বিজুর হাত ধরেই সঞ্জুর উত্থান। দেশের অন্যতম প্রতিশ্রুতিমান উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসাবে নিজের পরিচিত গড়ে তোলা। রবিবার রোমহর্ষক ম্যাচে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ছাত্রের ব্যাটিংয়ের কোন দিকটা সবচেয়ে ভাল লাগল? ‘টাইমিং। দুর্দান্ত টাইমিং। বড় শট খেলার জন্য পেশিবহুল চেহারার দরকার হয় না। ব্যাটের সুইটেস্ট স্পট দিয়ে বলকে মারতে পারলেই সাবলীলভাবে চার-ছক্কা মারা যায়। সেটাই দেখিয়ে দিয়েছে সঞ্জু,’ বলছিলেন বিজু।



করোনা আবহে ৬ মাসেরও বেশি সময় মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে। আইপিএলের প্রথম দুই ম্যাচে সঞ্জুর ব্যাটিং দেখে অবশ্য একবারের জন্যও কারও মনে হয়নি যে, বহুদিন ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। এর নেপথ্য কাহিনি শোনালেন বিজুই। বললেন, ‘তিরুঅনন্তপুরমে লকডাউনের ভীষণ কড়াকড়ি ছিল। ওর প্র্যাক্টিসও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সঞ্জু তাই পাশের জেলা কৈলানে চলে গিয়েছিল। সেখানকার বৌদ্ধমঠের সন্ন্যাসীর সঙ্গে থাকত। ওখানকার মাঠে প্র্যাক্টিস চালিয়ে গিয়েছিল। কৈলানের পাশেই সমুদ্রসৈকত। ফিটনেস বাড়াতে সেখানে স্যান্ড ট্রেনিং করত। ওখানে নিজস্ব ট্রেনার রেখেছিল। কড়া ডায়েট মেনে চলত। তাই নিজস্ব রাঁধুনিও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। কৈলানে রইফি উইলসন নামে ওর এক বন্ধু আছে। তার বাড়ি সংলগ্ন জায়গায় নেট প্র্যাক্টিসের সুযোগ ছিল। সেখানে প্লাস্টিক বলে অনুশীলন করেছে সঞ্জু। সেই পরিশ্রমের সুফল আইপিএলে পাচ্ছে ও।’



যদিও জাতীয় দলে বেশিরভাগ সময় উপেক্ষিতই হয়েছেন সঞ্জু। অনূর্ধ্ব ১৬ ও পরে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়ক ছিলেন। তবে সিনিয়র দলে ব্রাত্য থেকেছেন। ভারতের হয়ে টেস্ট বা ওয়ান ডে খেলেননি। টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয়েছিল ২০১৫ সালে হারারেতে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু পাঁচ বছরে মাত্র ৪টি টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি অবসর নিয়েছেন। এরপরেও কি সঞ্জুর সুযোগ প্রাপ্য নয়? বিজু বলছেন, ‘অবশ্যই প্রাপ্য। একবার বেঙ্গালুরুর আলুরে একটা প্র্যাক্টিস ম্যাচ হল। খেলা দেখতে গেলেন জাতীয় নির্বাচকেরা। কঠিন পিচে সেঞ্চুরি করল সঞ্জু। আর তারপর দলে ওকে না নিয়ে নেওয়া হল হনুমা বিহারীকে। পরে ঋষভ পন্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যদিও দুজনই সমান প্রতিভাবান। পন্থ অনেক সুযোগ পেয়েছে। সঞ্জু অবিচারের শিকার হয়েছে। ও দারুণ ব্যাটসম্যান। দক্ষ উইকেটকিপার। প্রথম স্লিপ হোক বা আউটফিল্ড, সর্বত্র দুর্দান্ত ফিল্ডিং করতে পারে। তবুও সুযোগ পায় না।’



হতাশা গ্রাস করে না ছাত্রকে? বিজু বললেন, ‘প্রত্যেকটা নির্বাচনী বৈঠকের পর মুষড়ে পড়ে। আমার কাছে এসে বলে, স্যার, আর কী করব। ওকে বোঝাই। বলি, পারফর্ম করে যেতে হবে। সঞ্জু ছাড়ার ছেলে নয়। ও নিশ্চয়ই জাতীয় দলের হয়েও সাফল্য পাবে। আইপিএলে ওর সেই সংকল্পেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’