কলকাতা: ছোটখাট চেহারার জন্য ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট মহলে তিনি পরিচিত ছোটু নামে। তবে ব্যাট হাতে নিলেই বিধ্বংসী। আমদাবাদের নবনির্মিত নরেন্দ্র মোদি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অভিষেকেই হইচই ফেলে দিয়েছেন ঈশান কিষাণ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ৩২ বলে ৫৬ রান। ৫ চার, ৪ ছক্কা। বিরাট কোহলিকে পিছনে ফেলে ম্যাচের সেরাও হয়েছেন।


তবু মন ভাল নেই ঝাড়খণ্ডের তরুণের। কেন? ‘দুটো শটের টাইমিং ঠিক হয়নি। রবিবার রাত দশটার সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করল, স্যার ম্যাচ দেখেছেন? বললাম, হ্যাঁ। ওয়েল প্লেড। খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু ছোটু বলল, স্যার, আমি সন্তুষ্ট নই। কারণ, দুবার টাইমিং মিস করেছি। অন্যসময় ওগুলো বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিই। কিন্তু পারলাম না। বলটা স্লোয়ার ছিল বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার ব্যাট তার আগে ঘুরে গিয়েছিল। ছোটু তাই বেশ হতাশ’, রাঁচি থেকে ফোনে এবিপি আনন্দকে বললেন দেবাশিষ চক্রবর্তী। ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার প্রাক্তন সচিব দেবাশিষ। ঈশানের উত্থানের নেপথ্যে তাঁর ভূমিকাও অপরিসীম। ছোট থেকে প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটারকে আগলে রেখেছেন। ‘পিন্টু স্যার’কে (এই নামেই ঝাড়খণ্ডের ক্রিকেটমহলে পরিচিত বাঙালি দেবাশিষ) নিজের মেন্টর মানেন ঈশানও।


দেবাশিষ জানালেন, ঈশানের জন্ম বিহারে। সেখান থেকে রাঁচিতে চলে আসেন। দেবাশিষ বললেন, ‘তখন ওর মাত্র ৯ বছর বয়স। তখনও পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার কথা ভাবেনি। ওর সঙ্গেই কৌশল বলে একটি প্রতিভাবান ছেলে ছিল। ওরা তিন-চারজন বন্ধু মেকন কলোনিতে ঘর ভাড়া নিয়ে রাঁচিতে চলে আসে। মাণিক ঘোষ নামে এক স্থানীয় কোচের কাছে প্রশিক্ষণ নিত। নিজেরাই মাঠে প্র্যাক্টিস করত।’ দেবাশিষ যোগ করলেন, ‘১২ বছর বয়স থেকেই প্রচারের আলোয় ঈশান। সেই সময় রাঁচির জেলা স্তরের ম্যাচে বিধ্বংসী ব্যাট করতে শুরু করে দিয়েছিল।’


২০০৮-০৯ মরসুমে ঝাড়খণ্ডের জুনিয়র দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ঈশান। তারপর অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের জন্য ভারতীয় দলে সুযোগ। অধিনায়কত্ব। জুনিয়র ক্রিকেটে একটার পর একটা মাইলফলক তৈরি করা। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেবাশিষ বলছেন, ‘ভীষণ প্রাণোচ্ছ্বল ছেলে ঈশান। যতই চাপ থাকুক না কেন, মাঠে সতীর্থদের সঙ্গে ইয়ার্কি করে। ও নিজে বলে, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে রোহিত শর্মা ও হার্দিক পাণ্ড্য ওকে বদলে দিয়েছে।’


এক সময় ধৈর্য্যের অভাব ছিল। যে কারণে টানা বসে বই পড়তে পারতেন না ঈশান। দেবাশিষ বলছেন, ‘ধৈর্য্যের অভাবে বই পড়তে পারত না ও। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স সেটা শিখিয়েছে ওকে। মেন্টাল কন্ডিশনিং আর মনস্তত্ত্ব নিয়ে বই পড়ে এখন। বছরখানেক ধরে প্রচুর বই পড়ছে। ক্রিকেটের সমস্ত নামী লেখকদের লেখা বই পড়ছে। মানসিক শক্তি বাড়াতে মরিয়া ও। চাপের মুখে কীভাবে ঠাণ্ডা থাকা যায়, তা নিয়েই মগ্ন থাকে। আইপিএলের সময় কিটব্যাগে কী কী বই নিয়ে যাবে, এখন থেকে তা কিনতেও শুরু করে দিয়েছে।’


ব্যাটিং নিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে ঈশান। গত আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে একটি ম্যাচে আউট হয়ে এতটাই হতাশ হয়ে পড়েন যে, টিমহোটেলে নিজের ঘরে ফিরে চার ঘণ্টা শ্যাডো করেছিলেন ঈশান! ‘ও নিজেই এই গল্প শুনিয়েছিল। বলেছিল, গত আইপিএলে একটি ম্যাচে আউট হয়ে যাওয়ার পর হার্দিক পাণ্ড্য ওকে বলে, ব্যাট কোণাকুণি হয়ে যাওয়ায় উইকেট খুইয়েছে। ঈশান এতটাই হতাশ ছিল যে, হোটেলে নিজের রুমে ফিরে টানা চার ঘণ্টা ধরে শ্যাডো করেছিল। ও বরাবর এরকমই। কোনও ঔদ্ধত্য নেই। দলের জুনিয়রদের সঙ্গেও মজা করে। বুঝতেই দেবে না যে, ক্রিকেট নিয়ে সারাক্ষণ ভাবছে,’ বলছিলেন দেবাশিষ।


ছটফটে, প্রাণবন্ত উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের মধ্যে অনেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ছায়া দেখছেন। রাঁচিতে গিয়ে মেকন কলোনিতেই থাকতেন ঈশান। জাতীয় দলে ধোনির ফেলে যাওয়া জায়গা নিতে পারবেন ২২ বছরের বাঁহাতি? ভারতীয় ক্রিকেট কিন্তু স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছে।