কলকাতা: মালদার গাজল ব্লকের ধোয়াপাড়া গ্রাম। সেখানেই এক চিলতে মাটির বাড়ি নিশম সরকারের। স্ত্রী ও এক ছেলের সংসারে নিত্যসঙ্গী অভাব। চাষবাস করে দিন গুজরান করেন নিশম। মাঠে কখনও ফলে ধান, কখনও আলু। চাষের কাজে বাবাকে সাহায্য করে খুদে পুত্রও।


নিশম হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি যে, চাষবাসের কাজে তাঁকে সাহায্য করা পুত্রের হাতেই একদিন উঠবে তির ধনুক। আর অভ্রান্ত নিশানায় লক্ষ্যভেদ করে দেশকে সোনার পদক এনে দেবে সে।


জুয়েল সরকার (Juyel Sarkar)। সদ্য ষোলো পেরনো কিশোর দেশকে উপহার দিলেন গর্ব করার মতো মুহূর্ত। ইরাকের সুলয়ামানিয়াতে এশীয় তিরন্দাজি স্টেজ টু-র (Asia Cup Stage II) রিকার্ভ টিম ইভেন্টে সোনা জিতল ভারতীয় দল। যে দলে পার্থ সালাঙ্খে ও মৃণাল চৌহানের সঙ্গে রয়েছেন বেঙ্গল আর্চারি অ্যাকাডেমির ছাত্র জুয়েলও। বুধবার ফাইনালে ৫-১ সেটে বাংলাদেশকে হারিয়ে সোনা জিতেছে ভারতীয় দল। ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষদের পাশাপাশি জুয়েলদের লড়াই করতে হয়েছে ইরাকের প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গেও।


সোনা জেতার পর ইরাকের সুলয়ামানিয়া থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে এবিপি লাইভকে জুয়েল বলল, 'ফাইনালের সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। সবরকম প্রতিকলূতার বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হয়েছে।'


বয়স সবে ষোলো পেরিয়েছে। জুয়েলের তিরন্দাজি শুরুর বৃত্তান্তও বেশ ব্যতিক্রমী। গাজলের ধরনীভূবন বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করার সময়ই শিক্ষকেরা জানতে চান, ছাত্রদের মধ্যে কেউ তিরন্দাজিতে আগ্রহী কি না। খানিকটা কৌতূহল মেটাতেই রাজি হয়ে যায় জুয়েল। 'সালটা ২০১৬। কৌতূহলবশতই তিরন্দাজি শিখতে রাজি হই। গাজলের শঙ্করপুর মাঠে শ্রীমন্ত চৌধুরীর কোচিংয়ে তিরন্দাজি শুরু করি। তারপর রাজ্য সরকারের ঝাড়গ্রাম অ্যাকাডেমির জন্য ট্রায়াল হয় জলপাইগুড়িতে। সেখানে গিয়ে ১০ দিনের শিবিরের জন্য নির্বাচিত হই। ২০১৮তে শিবির থেকে নির্বাচিত হয়ে যোগ দিই অ্যাকাডেমিতে। সেখানে চন্দ্রশেখর লাগোরি, বর্জু সিংহ, সুব্রত দাসের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। রাহুল স্যার ও দোলা ম্যাডামও (রাহুল ও দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়) শিখিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন,' বলছিল জুয়েল।


অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জো। বাঁশ ও কাঠের তৈরি ধনুক দিয়ে তিরন্দাজির সাধনা শুরু হয়েছিল জুয়েলের। পাশাপাশি নিজেদের জমিতে কৃষিকাজে বাবাকে সাহায্যও করত জুয়েল। পরে অ্যাকাডেমি থেকে আন্তর্জাতিক মানের ধনুক দেওয়া হয়। নিশানাও ধারাল হয় জুয়েলের। 'স্কুল ন্যাশনালে (অনূর্ধ্ব) রুপো ও ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। সাব জুনিয়রে রুপো জিতি। তারপর জম্মু-কাশ্মীরে সিনিয়র ন্যাশনাল মিক্সড টিমে ব্রোঞ্জ জিতেছিলাম,' বলছিল জুয়েল। বাড়িতে একটাই স্মার্ট ফোন। ইরাক রওনা হওয়ার সময় সেটি নিয়ে গিয়েছে জুয়েল। ফলে দেশ ছাড়ার পর থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জুয়েল বলছে, 'বাড়িতে আর কোনও স্মার্ট ফোন নেই। তাই হোয়াটসঅ্যাপ কল করতে পারছি না। একেবারে দেশে ফিরেই কথা বলব না হয়।'


জাতীয় দলে এটাই প্রথম সুযোগ জুয়েলের। আর দেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে নেমেই পদক। জাতীয় দলের কোচ বিকাশ উপাধ্যায়ও জুয়েলের প্রতিভা দেখে খুশি। জুয়েল নিজে অবশ্য এশিয়া কাপের স্বর্ণপদকেই সন্তুষ্ট নয়। তার পাখির চোখ দেশের হয়ে আরও বড় সম্মান জয়। অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। যে স্বপ্নপূরণের জন্য চোয়াল শক্ত করছে এ বছরই মাধ্যমিক দেওয়া কিশোর।


আরও পড়ুন: বিরাট ধাক্কা, আইপিএল থেকে ছিটকে গেলেন ধোনির সেরা অস্ত্র