রিও দে জেনেইরো: মেলালেন তিনি মেলালেন।
লিওনেল মেসি, রবার্ট ব্রুস, কর্ণ। রবিবার আর্জেন্তিনার কোপা আমেরিকা জয়ের পর সব চরিত্রগুলি যেন মিলেমিশে একাকার।
রবার্ট ব্রুসকে মনে আছে? স্কটল্যান্ডের রাজা। ইংল্যান্ডের কাছে পরপর সাত যুদ্ধে হেরে পাহাড়ের গহ্বরে জীবন কাটাচ্ছিলেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে। কার্যত নিঃসঙ্গ। সহায়, সম্বলহীন। তারপর গুহায় এক মাকড়সার জাল বোনার নিদারুণ প্রয়াসে ব্রুসের নজর গেল আটকে। মাকড়সাটি দেওয়াল বেয়ে উঠছে, জাল বুনছে, কিন্তু শেষ করার আগেই পড়ে যাচ্ছে। হার মানছে না। ফের অবসন্ন শরীর নিয়ে পাথুড়ে দেওয়াল বেয়ে ওঠা এবং পড়ে যাওয়া। সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে ফের উৎরাইয়ের সংকল্প। বারবার চেষ্টা করতে করতে অবশেষে এল সাফল্য। মাকড়সার অদম্য ইচ্ছাশক্তি দেখে প্রাণিত হয়েছিলেন রবার্ট ব্রুস। নতুন উদ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে অবশেষে যুদ্ধে জয়লাভ। ইতিহাস মনে রেখেছে রবার্ট ব্রুসের নাছোড় মানসিকতা।
কর্ণ পৌরাণিক চরিত্র। মহাভারতে অর্জুনের সমতুল্য বীর বলে বর্ণিত। ছদ্ম পরিচয়ে ব্রহ্মাস্ত্রজ্ঞান লাভের জন্য তিনি তখন পরশুরামের আশ্রমে। পাছে অস্ত্রগুরুর ঘুম ভেঙে যায়, তাই শরীর কীটের দংশনে রক্তাক্ত হলেও যিনি স্থির হয়ে বসেছিলেন।
কোপা অভিযানে, মারাকানার ফাইনালে মেসিও কি কখনও ব্রুস, কখনও কর্ণ হয়ে ওঠেননি?
লিওনেল মেসি কি ভুলতে পেরেছিলেন মারাকানাকে? ব্রাজিলের যে স্টেডিয়াম তাঁকে প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আর জার্মানির কাছে ফাইনালে হেরে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল এই মারাকানাতেই। বিশ্বকাপ আর তাঁর দুই হাতের মধ্যে দূরত্বটা ছিল ঠিক চায়ের পেয়ালা আর ঠোঁটের মধ্যেকার ফাঁকের মতো। কাছে, কিন্তু যোজন দূরে...
মাঝে কোপা আমেরিকা ও কনফেডারেশনস কাপের ফাইনালে উঠেছেন। কিন্তু কখনও আদ্রিয়ানো নামের গোলসন্ধানী প্রতিপক্ষ, কখনও চিলির মারকুটে রক্ষণ তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবের জমিতে নামিয়ে এনেছে বারবার। আর সিক্ত চোখে মাঠ ছেড়েছেন মেসি। কিন্তু হাল ছাড়েননি। রবার্ট ব্রুসের মতোই। ফের নতুন করে স্বপ্ন বুনেছেন। ফের পরাস্ত হয়েছেন। হতাশা গ্রাস করেছে। খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছেন। শান্ত হওয়ার পর ফের তাঁর মনে নতুন করে জমাট বেঁধেছে পুরনো স্বপ্ন। আর্জেন্তিনার হয়ে ট্রফি জয়ের হাতছানি।
কোপায় তো মেসি কর্ণকেও মনে করিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা অনেকেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলছিলেন যে, আর্জেন্তিনা জার্সিতে কোনওদিন এত সংকল্পবদ্ধ দেখায়নি মেসিকে। নিজে গোল করেছেন। তার চেয়েও বেশি গোল করিয়েছেন। টুর্নামেন্টে সাতটি ম্যাচ খেলেছেন। তার মধ্যে পাঁচটিতে ম্যাচের সেরা। বিপক্ষের জুতোর স্পাইকে বাঁ পায়ে গভীর ক্ষত হয়েছে। যে বাঁ পায়ের জাদু দেখতে রাতের পর রাত জাগে ফুটবলবিশ্ব, সেই বাঁ পা দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে রক্ত। ভিজে রক্তিম হয়েছে সাদা মোজা। মেসি অবিচল। নিজের চোট নিয়ে নির্লিপ্ত। চোয়াল কঠিন করে ফ্রি কিকের বল সাজিয়েছেন। কর্ণের মতোই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে।
ফাইনালেও তো কর্ণের মতোই শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে থাকার অঙ্গীকারই দেখিয়েছেন মেসি। রবিবার মারাকানায় একবারই গোল করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল মেসির। অ্যাঙ্খেল দি'মারিয়ার বাড়ানো বল মেসির পায়ে পড়তেই সেই ক্ষিপ্র দৌড়। সামনে শুধু আগুয়ান ব্রাজ়িল গোলকিপার। কিন্তু মেসি ম্যাজিক তৈরি হয়েও যেন হল না। ব্রাজ়িলের গোলরক্ষকের শরীরে বল জমা দিয়ে এলেন আর্জেন্তিনার অধিনায়ক। গোটা ম্যাচে যাঁকে বাকি টুর্নামেন্টের মতো অপ্রতিরোধ্য লাগেনি।
আর দি'মারিয়ার করা গোলে কোপা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আর্জেন্তিনার কোচ ফাঁস করলেন, কী মরিয়া সংকল্প নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার তোয়াক্কা না করে রবিবার মারাকানায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাঠে ছিলেন মেসি। লিওনেল স্কালোনি বলেছেন, 'চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমার কাছে কিছু পাল্টায়নি। মেসিই সেরা। আমি বরং ব্রাজ়িলের সকলকে জিজ্ঞেস করতে চাই, মেসির কি নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য ট্রফি জেতার প্রয়োজন রয়েছে?' তারপরই স্কালোনি জানিয়েছেন যে, কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ও ব্রাজ়িলের বিরুদ্ধে ফাইনালে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট উপেক্ষা করে মাঠে নেমেছিলেন মেসি! অথচ হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটকে ফুটবলারদের সবচেয়ে কঠিন কাঁটা বলে মনে করা হয়। যদিও ট্রফি জিততে মরিয়া মেসি সে সবের পরোয়া করেননি। কর্ণরা তো এমনই হন।
তবে কর্ণের মতো পরিণতি হয়নি মেসির। বরং রবার্ট ব্রুসের সংকল্পে সওয়ার হয়ে কার্যত অসাধ্য সাধন করলেন রবিবার। দেশের জার্সিতে তাঁর প্রথম ট্রফি জয় অসাধ্যই তো!
কেন? একটু পিছনের দিকে হাঁটা যাক। সাত বছর আগের এক জুলাইয়ের রাত ভুলতে পারেন না মেসি। কী করেই বা ভুলবেন গঞ্জালো হিগুয়াইন ও রদ্রিগো পালাসিও-র সেই অবিশ্বাস্য মিস! বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির প্রায় ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে না পারা। যা দেখে ফুটবল ঈশ্বরও হয়তো হেসেছিলেন। অবজ্ঞার হাসি। হয়তো তিনিও গোটা বিশ্বের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠেছিলেন, কী হে তুমি নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার? তোমার যাবতীয় সাফল্য তো বার্সেলোনা জার্সিতেই সীমাবদ্ধ! দেশের হয়ে কোথায় আর নায়ক হতে পারলে? মারিও গোৎজের শট লা আলবিসেলেস্তে শিবিরে আঁধার নামিয়েছে। আর তিনি মাঠ ছেড়েছেন নতমস্তকে। নিয়তি মেনে নিয়ে।
ফুটবল ঈশ্বর তখনও হয়তো মুচকি হেসেছিলেন। তা নাহলে কী করেই বা ফের এক জুলাইয়ে মারাকানাতেই তিনি হাজির করলেন মেসিকে। ফের এক ফাইনালে। যে টুর্নামেন্ট ব্রাজ়িলে হওয়ার কথাই ছিল না, তাই কি না সাম্বার দেশে হাজির। হোক না সে কোপা আমেরিকা, না হোক বিশ্বকাপ, ফাইনাল তো বটে!
পাশে কোনও জ়াভি-ইনিয়েস্তার মাপের ফুটবলার নেই। নিদেনপক্ষে দুরন্ত ফর্মে থাকা একটা সের্জিও আগুয়েরো বা অ্য়াঙ্খেল দি মারিয়াও ছিল না। ফাইনাল বাদ দিলে দি'মারিয়া তো খেলছিলেন পরিবর্ত হিসাবে। তবু মেসির বাঁ পা খুঁজে নিচ্ছিল তেকাঠি। আর নিজে গোল করার পাশাপাশি কখনও গোলের ঠিকানা লেখা বল বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন নবাগত লউতারো মার্তিনেজ় বা পাপু গোমেজকে, কখনও রদ্রিগো দে পল-কে। অনভিজ্ঞ সতীর্থদের নিয়েই চলেছে মেসির সংগ্রাম।
কতটা মরিয়া সেই লড়াই? পাশাপাশি দুটি ছোট্ট তথ্য সাজিয়ে দেওয়া যাক।
সমালোচকেরা বলে থাকেন, মেসি তো স্পেনের, আর্জেন্তিনার হল কবে? মেসিকে নাকি কোনওদিন আর্জেন্তিনার জাতীয় সঙ্গীতের সময় মাঠে ঠোঁট নাড়তে দেখা যায় না। দলের জয়ে উল্লাস করেন না। ড্রেসিংরুমে নাকি নীরব থাকেন।
সেই মেসিই সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার সেরা স্ট্রাইকার ইয়েরি মিনা টাইব্রেকারে গোল নষ্ট করার পর লাফিয়ে উঠেছিলেন। প্রবল চিৎকার করে বলতে শুরু করেছিলেন, 'বাইলা আহোরা, বাইলা আহোরা'। স্পেনীয় ভাষা। বাংলা করলে দাঁড়ায় 'নাচো, এবার নাচো'। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে কলম্বিয়া জেতার পর মিনা নেচেছিলেন। মেসি সেমিফাইনালে বিদ্রুপ ছুড়ে দিয়েছিলেন মিনাকে। মেসির মতো আপাত শান্ত ফুটবলার, প্রতিপক্ষের কড়া ট্যাকলেও যিনি মুখ খোলেন না, বড় জোড় কার্ড দেখানোর আবেদন করেন, তিনি কি না স্লেজিং করছেন বিপক্ষকে!
আসলে এই মেসি মরিয়া ছিলেন। এই মেসি ট্রফি ছাড়া কিছু দেখছিলেন না। এই মেসি বুঝে গিয়েছিলেন, সারাবছর ক্লাবের জার্সিতে ডজ়-ড্রিবল-ফ্রি কিকের জাদুতে যতই বিশ্ব সম্মোহিত হোক না কেন, এবারও না পারলে সেই অপ্রীতিকর প্রশ্ন তো আজীবন তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করবেই। তুমি নাকি বিশ্বের সেরা ফুটবলার? দেশের হয়ে কী করেছো বাপু?
চ্য়াম্পিয়ন না হতে পারলে যে প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াতেন মেসি। ছোটবেলা যাঁর ফুটবল দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে টিস্য়ু পেপারে চুক্তি পাকা করে ফেলেছিলেন বার্সেলোনার পোড়খাওয়া ফুটবল কর্তা। সেসব বৃত্তান্ত ফুটবল ইতিহাসের পাতায় গল্প হয়েই থেকে যেত। আর বাস্তবের রূঢ়, রুক্ষ জমি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পায়ের তলা থেকে ক্রমশ সরে যেত।
ফের রানার্স হয়ে ফিরলে তাঁর রক্তক্ষরণ বন্ধ হতো না। বরং মারাকানার পুরনো ঘা ফের খুঁচিয়ে উঠত। অদৃশ্য যন্ত্রণায় হয়তো কাতরাতে থাকত সাড়ে পাঁচ ফিটের সামান্য বেশি উচ্চতার অবয়ব।
অনুরাগীরা বলতেন, কী হয়েছে? পুসকাস-ইউসেবিও-প্লাতিনিরাও তো পারেননি! সোশ্যাল মিডিয়ায় মেসির সমর্থনে ঝড় উঠত। কোচ স্কালোনি তো ফাইনালের আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, কোপা না জিতলেও মেসিই সেরা।
মেসি যদিও রানার্সের জন্য বরাদ্দ সান্ত্বনার ঝড় চাননি। জয়মালা পরেই মাঠ ছাড়তে চেয়েছিলেন। আর্জেন্তিনার জার্সিতে প্রথম বড় ট্রফি জিততে চেয়েছিলেন। সেই তাগিদের সামনে পায়ের রক্তক্ষরণ বা হ্যামস্ট্রিংয়ের যন্ত্রণা তো তুচ্ছ!
অন্তত একটা স্বপ্নপূরণ হয়েছে মেসির। দেশের জার্সিতে অন্তত একটা ট্রফি দুহাতে তুলে ধরতে পেরেছেন। রবিবারর মেসি যেন শাপমুক্ত। মারাকানায় রেফারি শেষের বাঁশি বাজাতেই বসে পড়লেন দুই হাঁটুর ওপর। হাউ হাউ করে কাঁদছেন আধুনিক ফুটবলের কিংবদন্তি। মাঠ থেকে ভিডিও কলে গলায় চ্যাম্পিয়নের পদক দেখাচ্ছেন স্ত্রী আন্তোনেল্লাকে। শিশুসুলভ সারল্যে। ড্রেসিংরুমে নাচছেন সতীর্থদের সঙ্গে। গান করছেন।
একমাত্র মেসিই জানেন যে, ব্রুস কিংবা কর্ণকে বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবে নামিয়ে আনা কতটা কঠিন। সকলে পারেন না। হয়তো শুধু মেসিই পারেন।
আর পারেন বলেই তাঁর সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে পরবর্তী লক্ষ্য। সাজিয়ে দিয়েছে স্বয়ং বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা। বিশ্বকাপের সামনে মেসির অ্যানিমেশন পোস্ট করে ফিফা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছে, 'নাউ আইস টার্ন টু দ্য বিগ ওয়ান'। এবার লক্ষ্য আরও বড়। বিশ্বকাপ। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। মারাকানা যে স্বাদ থেকে সাত বছর আগে বঞ্চিত করেছিল মেসিকে।
ব্রুসের সংকল্প আর কর্ণের সহনশীলতা নিয়ে মেসিও হয়তো মানসিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।