কলকাতা: বুধবার জামশেদপুরের জেআরডি টাটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে এক গোলে পিছিয়ে থেকেও শেষে ৩-২-এ জিতল সবুজ-মেরুন বাহিনী। (Mohun Bagan Super Giants) ফলে তারা আবার লিগ টেবলের শীর্ষে উঠে পড়ল। চার ম্যাচে তাদের সংগ্রহ ১২ পয়েন্ট। অন্যদিকে, দুর্ভাগ্য জামশেদপুর এফসি-র। খাতায় কলমে তারকাহীন, দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত লড়াই করেও ব্যবধান ধরে রাখতে পারল না তারা। ছ’টি ম্যাচের মধ্যে তিন নম্বর হারের ফলে তারা নেমে গেল আট নম্বরে। 


এ দিন তরুণ ফরোয়ার্ড শনন খানের গোলে ছ’মিনিটেই এগিয়ে যায় জামশেদপুর। ২৯ মিনিটে সমতা আনেন আরমান্দো সাদিকু ও ৪৮ মিনিটের মাথায় ব্যবধান তৈরি করে নেন লিস্টন কোলাসো। ৮০ মিনিটের মাথায় ফের গোল করে ব্যবধান বাড়ান কিয়ান নাসিরি। কিন্তু ৮৬ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে ব্যবধান কমান জামশেদপুরের পরিবর্ত ফরোয়ার্ড গিনির স্টিভ আম্বরি। নয় মিনিটের স্টপেজ টাইমে সমতা আনার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠলেও মোহনবাগান রক্ষণের দুর্ভেদ্য দেওয়ালে আর চিড় ধরাতে পারেনি তারা। 


আইএসএলে(ISL)  পিছিয়ে থেকেও ম্যাচ জেতার ঘটনা মোহনবাগান শেষবার ঘটিয়েছিল এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি, কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে ২-১-এ জিতেছিল কলকাতার দল। এ দিন আরও কঠিন লড়াইয়ে ৩-২-এ জয় পেল তারা। তবে জামশেদপুরকেও কম লড়াই লড়তে হয়নি। ৭০ মিনিটের মাথায় তাদের গোলকিপার টিপি রেহনেশ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। তার পর ম্যাচের প্রায় ৩০ মিনিট (বাড়তি সময়-সহ) দশজনে খেলে দুরন্ত লড়াই করে তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।     


ফিটনেসের কারণে এ দিন খেলতে পারেননি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি, মিডফিল্ডার হুগো বুমৌস ও স্ট্রাইকার জেসন কামিংস। তাঁদের জায়গায় মাঠে নামেন হেক্টর ইউস্তে, গ্ল্যান মার্টিন্স ও আরমান্দো সাদিকু। অন্য দিকে জামশেদপুর এফসি এ দিন চারটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামায়। 


আনোয়ারের অভাব এ দিন প্রথম থেকেই টের পায় মোহনবাগান, যখন শুরু থেকেই ঘন ঘন আক্রমণে উঠতে শুরু করে জামশেদপুর এফসি। তাই ছ’মিনিটের মাথায় তাদের প্রথম গোলটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। এই মরশুমেই প্রথম ইন্ডিয়ান সুপার লিগে খেলা ১৯ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড শনন খান যে গোলটি করে দলকে এগিয়ে দেন, তাতে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের অবদানই ছিল বেশি। 


প্রথমত, শুভাশিস বোস বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে শননের পায়ে বল দিয়ে দেন। দ্বিতীয়ত, দলের ডিফেন্ডারদের ওপর আর ভরসা রাখতে না পেরে গোল ছেড়ে একেবারে বক্সের বাইরে বেরিয়ে আসেন গোলকিপার বিশাল কয়েথ। এই দুই মারাত্মক ভুলের মাশুল দিতে হয় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে। ছটফটে শনন বল নিয়ে বক্সে ঢুকে কোণাকুনি শটে ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দেন (১-০)। তাঁকে আটকানোর মতো প্রতিপক্ষের কেউই ছিলেন না।


এই গোলের ন’মিনিট পরে ফের দূরপাল্লার গোলমুখী শট নেন শনন খান। কিন্তু তাঁর ভলি উড়ে গিয়ে পড়ে ক্রসবারের মাথায়। শুরুর দিকে জামশেদপুর এফসি-র ট্রানজিশন যতটা দ্রুত ছিল, মোহনবাগানকে এই ব্যাপারে ততটাই গতিহীন দেখা যায়। ড্যানিয়েল চিমাকে সামনে রেখে এ দিন সমানে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করে যায় ইস্পাতনগরীর দল। কিন্তু ফিনিশিংয়ের অভাবে সেগুলি গোলে পরিণত করতে পারেনি।  


মোহনবাগান অবশ্য মাঝে মাঝেই প্রতি আক্রমণে ওঠে। ১৯ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর দূরপাল্লার শট টিপি রেহনেশ না বাঁচালে গোল পেয়েই যেতেন তিনি। এর দশ মিনিট পরে প্রতি আক্রমণ থেকেই সমতা এনে ফেলেন আরমান্দে সাদিকু। তবে এই গোলের পিছনে আরও দু’জনের অবদান অবশ্যই উল্লেখ্য। মাঝমাঠ থেকে ডান উইংয়ে বল বাড়ান সহাল আব্দুল সামাদ, যেখানে ছিলেন মনবীর সিং। তিনি বল নিয়ে কিছুটা উঠে বক্সের মধ্যে ক্রস বাড়ান সাদিকুকে। পায়ের টোকায় জালে বল জড়াতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি আলবানিয়ান তারকার (১-১)।


গোল খেয়েও ফের ব্যবধান তৈরির চেষ্টা ছাড়েননি ড্যানিয়েল চিমারা। তাদের আক্রমণের সময় মনবীর, কোলাসোদেরও নেমে আসতে দেখা যায়। ৪১ মিনিটের মাথায় বক্সের ভেতর ডানদিক থেকে কোণাকুনি শট নিলেও তা অল্পের জন্য দূরের পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৪৪ মিনিটের মাথায় মাঝমাঠ থেকে পাওয়া বল নিয়ে বক্সে ঢুকে গোলে কোণাকুনি শট নেন পেট্রাটস, যা রেহনেশ বাঁচিয়ে দেন ঠিকই, তবে তার আগেই সহকারী রেফারি অফসাইডের ফ্ল্যাগ তুলে দেন। 


পরের মিনিটেই নিজেদের এলাকা থেকে দেওয়া সহালের পাস নিয়ে মাঝমাঠ থেকে দৌড় শুরু করে বক্সের মাথা থেকে গোলে শট নেন অরক্ষিত সাদিকু। কিন্তু এবারও রেহনেশের হাতে চলে যায় সেই দুর্বল শট। দ্বিতীয়ার্ধের বাড়তি সময়ে বক্সের সামনে থেকে নেওয়া কোলাসোর ফ্রি কিক বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ফের আর এক ফ্রি কিক থেকে পেট্রাটসের শট গোলে ঢোকার আগেই প্রতিহত করেন জামশেদপুর গোলকিপার। প্রথমার্ধে যেখানে মোহনবাগান চারটি শট গোলে রাখে, সেখানে জামশেদপুরের মাত্র একটি শট ছিল লক্ষ্যে এবং সেটি থেকেই গোল পায় তারা।


বিরতির পরে যখন দুই দলই উজ্জীবিত ফুটবল খেলতে শুরু করে, তখনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল, কেউ না কেউ আর এক গোল দেবে। বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি, মাত্র তিন মিনিটের মাথাতেই লিস্টন কোলাসো তাঁর ট্রেড মার্ক শট দিয়ে দলের দ্বিতীয় গোল তুলে নেন। বাঁ দিক দিয়ে উঠে কাট ইন করে বক্সের মাথা থেকে শট নিয়ে গোলের বাঁ দিকের নীচ দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেন (১-২)।


এক গোলে এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে পড়ায় ফের সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে জামশেদপুর। কিন্তু আগের চেয়ে তাদের প্রতিপক্ষের রক্ষণ অনেক সঙ্ঘবদ্ধ ছিল। ৫৮ মিনিটের মাথায় তাদের পঞ্চম কর্নার থেকে হেড করে গোলের দিকে বল ঠেলে দেন এলসিনহো, যা ডানদিকের কোণ দিয়ে গোলে ঢোকার আগেই তা বারের ওপর দিয়ে বের করে দেন বিশাল কয়েথ। এর তিন মিনিট পরেই, ৬১ মিনিটের মাথায় গ্ল্যান মার্টিন্সের জোরালো, নীচু শট বাঁচিয়ে দেন রেহনেশ। 


কিন্তু ৬৮ মিনিটের মাথায় যে ঘটনা ঘটে, তা ছিল অভাবনীয়। জামশেদপুরের গোলরক্ষক টিপি রেহনেশ বক্সের বাইরে বেরিয়ে এসে গোলমুখী সহালের পায়ে সজোরে আঘাত করেন, যা সহালের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারত। ছিটকে আসা বলে শট নিয়ে জালে জড়িয়ে দেন সাদিকু। কিন্তু তার আগেই সহালকে মারাত্মক ভাবে রেহনেশ বাধা দেওয়ার পরেই ফ্রি কিকের বাঁশি বাজিয়ে দেন রেফারি। ফলে সেই গোলও বাতিল হয়ে যায়। রেহেনেশকে লাল কার্ডও দেখানো হয়। যার ফলে শেষ ৩০ মিনিট (বাড়তি দশ মিনিট-সহ) দশ জনে খেলতে হয় ইস্পাতনগরীর দলকে। পরিবর্ত গোলকিপার বিশাল যাদব মাঠে নামেন এবং সে জন্য মাঠ ছাড়তে হয় শনন খানকে। একই সঙ্গে স্তেভানোভিচের জায়গায় নামেন প্রাক্তন মোহনবাগানী সেম্বয় হাওকিপ। 


৭৩ মিনিটের মাথায় গ্ল্যান মার্টিন্সের জায়গায় নামেন কিয়ান নাসিরি। আক্রমণে ধার বাড়ানোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেন কোচ হুয়ান ফেরান্দো। একই উদ্দেশ্যে গিনির ফরোয়ার্ড স্টিভ আম্বরিকে নামায় জামশেদপুর। চিমার জায়গায় নামেন তিনি। কিন্তু ফল হয় উল্টো। আম্বরি নামার পরেই কিয়ান নাসিরির গোলে ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নেয় মোহনবাগান এসজি। মাঝমাঠ থেকে পাওয়া বল নিয়ে প্রবল গতিতে কিয়ান বক্সে ঢুকে পড়েন। গোল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে বাধা দেন পরিবর্ত গোলকিপার বিশাল যাদব। তাঁর গায়ে লেগেই বল উড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে গোলে (১-৩)। 


কিন্তু তৃতীয় গোলেও যে তাদের জয় সুনিশ্চিত হয়নি, তা মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা বুঝতে পারেন ৮৬ মিনিটের মাথায়, যখন পেনাল্টি থেকে দলের দ্বিতীয় গোলটি করেন আম্বরি। হেক্টর ইউস্তে গোলমুখী নিখিল বারলাকে বক্সের মাথায় অবৈধ ভাবে বাধা দেওয়ায় রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজিয়ে  দেন। গোলকিপারের বাঁ দিক দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেন আম্বরি (২-৩)।


এই গোলের পরেই ফের সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ইস্পাতনগরীর দল। মোহনবাগানকে রক্ষণে কোণঠাসা করে দেয় তারা। প্রথমে ইমরান খানের গোলমুখী শট অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ন’মিনিট বাড়তি সময় পেয়ে ড্র করার জন্য তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। আম্বরিকে সামনে রেখে নাগাড়ে আক্রমণ করে যায় জামশেদপুর। ৯৫ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথায় থেকে আম্বরির নেওয়া জোরালো শট ক্রসবারে ধাক্কা খায়। শেষ দিকে রক্ষণে শক্তি বাড়াতে সাদিকুর জায়গায় আশিস রাইকে নামান ফেরান্দো। তাদের দুর্ভেদ্য রক্ষণের দেওয়ালে চিড় ধরিয়ে আর গোল করা সম্ভব হয়নি হোম টিমের পক্ষে।