সৌরাশিস বলছেন, ‘বাংলার হয়ে অনূর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেট খেলার সময় এমএসের (এই নামেই ধোনিকে ডাকেন সৌরাশিস) সঙ্গে প্রথম আলাপ। ও তখন বিহার দলের হয়ে খেলত। পরে অনূর্ধ্ব ১৯ পর্বেও একে অপরের বিরুদ্ধে বা জোনাল ম্যাচে একসঙ্গে খেলেছি। তবে বয়ভিত্তিক স্তরে নয়, ধোনির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি সিনিয়র ক্রিকেটে। পূর্বাঞ্চলের হয়ে অনেক ম্যাচ খেলেছি একসঙ্গে। আমার অভিষেক বিহারের বিরুদ্ধে। তবে সেই ম্যাচে ও ছিল না। ও মনে হয় বিহারের সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম খেলে ২০০০ সালে।’
ধোনির কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে আকৃষ্ট করত? সৌরাশিস বলছেন, ‘ছোট থেকেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতাম। এমএস পশুপ্রেমী। কুকুর ভালবাসে দারুণ। কিনান স্টেডিয়ামে খেলা থাকলেই দেখতাম, মাঠের চারপাশের কুকুরের বাচ্চাদের বিস্কিট খাওয়াচ্ছে, আদর করছে। ওর ভ্যাম্পায়ার কোম্পানির একটা বড় কিটব্যাগ ছিল। ওকে দেখতাম কিটব্যাগের মধ্যে হয়তো একটা কুকুর ছানাকে নিয়ে চলে গেল হোটেলে। লম্বা চুল। ফ্ল্যামবয়েন্স। এমএসের মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার তো ছিলই।’
ধোনিকে নিয়ে আর এক মজার কাহিনী শোনালেন সৌরাশিস। ‘চকলেট আর দুধ খেতে খুব ভালবাসত এমএস। বেশ মনে পড়ছে একটা ঘটনা। পূর্বাঞ্চলের হয়ে দেওধর ট্রফি খেলতে যাব আমরা। কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার কথা। আমরা যারা কলকাতার ছেলে, বাড়ি থেকেই সরাসরি বিমানবন্দরে পৌঁছে যেতাম। আর বিহার, ওড়িশা, অসমের মতো পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের ক্রিকেটারেরা আগেরদিন কলকাতায় এসে বিমানবন্দরের কাছাকাছি আকাশগঙ্গা নামের একটা হোটেলে থাকত। পরের দিন সকালে সকলে বিমানবন্দরে মিলিত হতাম,’ বলছিলেন সৌরাশিস। যোগ করলেন, ‘সেবার আমাদের খুব ভোরে ফ্লাইট। আমরা কলকাতার ক্রিকেটারেরাও ঠিক করলাম যে, বিমানবন্দর সংলগ্ন হোটেলেই থাকব। সেই মতো আমি আর লক্ষ্মীরতন শুক্ল আগের দিন রাতে হোটেলে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখলাম এমএসের ঘরের দরজা খোলা, ক্রিকেটারেরা সকলেই সেখানে। খাওয়া-দাওয়া চলছে। কী মেন্যু? দুধ আর চকলেট! আমরাও যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ জমিয়ে আড্ডা হল। এমএস এরকমই।’
ধোনির সঙ্গে খেলা কোনও স্মরণীয় ম্যাচ? সৌরাশিস বলছেন, ‘কিছু ম্যাচ চোখে লেগে রয়েছে। ওর প্রথম ওয়ান ডে সেঞ্চুরি পূর্বাঞ্চলের হয়ে। সেবার আমরা প্রথমবার দেওধর ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। দেবাঙ্গ গাঁধীর নেতৃত্বে। পারাদ্বীপ, আগরতলা, কিনানে খেলা হয়েছিল টুর্নামেন্ট। শেষ ম্যাচটা ছিল সেন্ট্রাল জোনের বিরুদ্ধে। কিনান স্টেডিয়ামে। সেন্ট্রাল জোনের বোলিং দুর্দান্ত। নিখিল চোপড়া তখন উত্তরপ্রদেশের হয়ে খেলত। সেন্ট্রাল জোন দলে ছিল। কিনান স্টেডিয়ামে এমএস নিখিলের বলে কয়েকটা যা ছক্কা মেরেছিল না, অবিশ্বাস্য! প্লেয়ার্স প্যাভিলিয়নের পিছনে একটা টাওয়ার আছে। সেই টাওয়ারের ওপর দিয়ে বল উড়ে গিয়েছিল।’ বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার যোগ করলেন, ‘দলীপ ট্রফির ফাইনালে মোহালিতে উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে ম্যাচে ওর খেলা একটা শটের কথাও মনে আছে। এমএস ফাইনালে আমাদের হয়ে ওপেন করল। মোহালির সবুজ উইকেটে নর্থ জোন টস জিতে আমাদের ব্যাট করতে পাঠাল। ম্যাচের প্রথম বলে আশিস নেহরার বলে স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে একটা ছক্কা মেরেছিল। ওরকম শট ওর পক্ষেই সম্ভব।’
আর ধোনির হেলিকপ্টার শট? সৌরাশিস বলছেন, ‘রাজকোটে একটা ম্যাচ খেলেছিলাম। পাথরের মতো শক্ত উইকেট। মধ্যাঞ্চল প্রথমে ব্যাট করে ৩৩৮-এর মতো রান করেছিল। সুরেশ রায়না সেঞ্চুরি করেছিল। পূর্বাঞ্চল ২ ওভার বাকি থাকতে ম্যাচটা জিতে গিয়েছিল। এমএস আর শিবশঙ্কর দাস ওপেন করেছিল। এমএস ৩০ বলে ৮০ মতো রান করেছিল। কী মার যে মেরেছিল না!’
ধোনির হাতে রান আউটও হতে হয়েছিল সৌরাশিসকে। ‘এমএস অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেটে ভারতীয় দলে সুযোগ পায়নি। ও সরাসরি ভারতীয় এ দলে খেলে কিনিয়াতে। তারপর চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে সুযোগ পায়। চেন্নাইতে সেই টুর্নামেন্টে ইন্ডিয়া সিনিয়র দলে ছিল ও। আমি আর মহারাজদা (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) ইন্ডিয়া এ দলে ছিলাম। ওই ম্যাচে আমি হরভজন সিংহের একটা বল কভার আর পয়েন্টের মধ্যে ঠেলে সিঙ্গলস নিতে গিয়েছিলাম। ইরফান পাঠান বল ধরে থ্রো করে। ধোনি উইকেট ভেঙে দেয়। এমএস আমাকে বলেছিল, তোকে আমার হাতেই আউট হতে হল!’ বলছিলেন সৌরাশিস।
কলকাতায় শ্যামবাজার ক্লাবের হয়ে পি সেন ট্রফি খেলেছিলেন ধোনি। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছিলেন সৌরাশিস ও সৌরভ। প্রথম রাউন্ডে হেরে যাওয়ায় ধোনির বিরুদ্ধে সেবার খেলা হয়নি সৌরাশিসের। সতীর্থদের কাছে ধোনি বরাবরই জনপ্রিয়। কেন? ফাঁস করলেন সৌরাশিস। বললেন, ‘মাঠের বাইরে ও ভীষণ মজার ছেলে। জোকস বলত। সবসময় মজা করত। তবে মাঠে নেমে কী অদ্ভুত শান্ত, সংযত। ভাল কিছু করলেও আনন্দের সেভাবে বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। আবার ম্যাচ হেরেও ভেঙে পড়তে দেখিনি। ভারসাম্য বজায় রেখে চলত বরাবর। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ওর ভীষণ পছন্দের। তাই সকলেই ওকে পছন্দ করে।‘