অশোক ডিন্ডা, জাতীয় দলের প্রাক্তন পেসার
কলকাতা: বিশ্বকাপে (ODI World Cup) হইচই ফেলে দিয়েছে আমার বন্ধু ও এক সময়ের সতীর্থ মহম্মদ শামি (Mohammed Shami)। ৬ ম্যাচে ২৩ উইকেট। ওভার প্রতি মাত্র ৫ রান করে খরচ করছে। বিশ্বকাপের ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার দাবিদার। চলতি বিশ্বকাপে ভারতের পিচে যেখানে বেশিরভাগ ম্যাচে সাড়ে তিনশো-চারশো রান উঠছে, সেখানে এই বোলিং অনবদ্য।
শামিকে প্রথম দেখেছিলাম বাংলার নেটে। তার আগেই ওর কথা কানে এসেছিল। শুনেছিলাম যে, ডালহৌসি ক্লাবে একটা বোলার সই করেছে। দারুণ প্রতিভা নাকি। খুব জোরে বল করে। তবে সেবার স্থানীয় ক্রিকেটে ভাল কিছু করতে পারেনি শামি। তারপর ও যোগ দেয় টাউন ক্লাবে। সেখান থেকেই ওর নজরকাড়া শুরু। তারপর মোহনবাগানে খেলেছে। বাংলা, পূর্বাঞ্চল, আইপিএল ও শেষে ভারতীয় দল - প্রত্যেকটি ধাপ পেরিয়ে শামি আজ এই জায়গায়।
বাংলার নেটে যেদিন ওকে প্রথম দেখি, মনে আছে খুব জোরে বল করছিল। ভাল বোলিং করছিল। সম্ভবত ২০০৭-০৮ মরশুম হবে। তখন আমি ভারতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়ছি। শুরুর দিকে বাংলা দলে সুযোগ পাচ্ছিল না শামি। বাংলার পেস বোলিং আক্রমণ মানে তখন একদিক থেকে আমি আর এক দিক থেকে রণদেব বসু। প্রথম একাদশে শামিকে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে সুযোগ পেয়েই ও কাজে লাগিয়েছিল। উইকেট তুলেছিল।
ইনদওরে দলীপ ট্রফির ফাইনালের কথা খুব মনে পড়ে। মহম্মদ কাইফ, পীযূষ চাওলাদের মধ্যাঞ্চলের বিরুদ্ধে দুই প্রান্ত থেকে দুজনে বল করছিলাম। তার আগে ও একটাও ম্যাচ খেলেনি। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আমার সঙ্গে পেসার হিসাবে খেলছিল আবু নাচিম ও বসন্ত মোহান্তি। সেই বছর প্রচুর উইকেটও নিয়েছিলাম। মহম্মদ শামি সোজা ফাইনালে খেলেছিল। সেখানে ও ৮ উইকেট নিল। আমি ৭ উইকেট নিয়েছিলাম। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পূর্বাঞ্চল।
ছত্তীসগঢ়ের বিরুদ্ধেও আমরা দুজনে মিলে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। আমি নিয়েছিলাম দশ উইকেট। শামি ৯টি। শামি থাকা মানেই আমিও নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে বোলিং করতাম। দুজনের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা চলত।
ইডেন গার্ডেন্সে ২০১৩-১৪ মরশুমের বিজয় হাজারে ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে ম্যাচের কথাও কোনওদিন ভুলব না। ১৬৭ রানের পুঁজি নিয়ে ৭৭ রানে জিতেছিল বাংলা। আমি ও শামি সেবারও প্রতিপক্ষ শিবিরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলাম। আর সেটা ছিল তামিলনাড়ুর ভীষণ শক্তিশালী দল। মুরলী বিজয় থেকে শুরু করে দীনেশ কার্তিক, বদ্রীনাথ সবাই খেলেছিল সেই ম্যাচে।
রাজকোটের একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। রঞ্জি ট্রফিতে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়েছিলাম। রাস্তার ধারের এক ফুচকাওয়ালার পুরো গাঁটরি তুলে এনেছিলাম। হোটেলের রুমে বসে আমি, শামি, ঋদ্ধিমান, রুকু (অনুষ্টুপ মজুমদার), সুদীপ (চট্টোপাধ্যায়) পেট ভরে ফুচকা খেয়েছিলাম। বিরিয়ানি খেতে খুব ভালবাসে ও। রোজ বিরিয়ানি দাও, খেয়ে নেবে। শামির সঙ্গে বাংলার হয়ে যতবার বাইরে সফর করেছি, খাওয়াদাওয়া হয়েছে জম্পেশ। আইপিএল খেলার সময় দুজনে হয়তো দুই দলে খেলছি। কিন্তু দেখা হলেই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছি।
আমরা কোনওদিন একে অপরকে হিংসা করিনি। কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। ও উইকেট নিলে আমি খুশি হতাম। আমার সাফল্যে ও খুশি হতো। পেসারদের মধ্যে অনেক সময় রেষারেষি থাকে। আমরা সেদিক থেকে ব্যতিক্রমী।
শামির সিম পোজিশন বরাবরই ভাল। কিন্তু যেটা নজর কাড়ছে, সেটা হল ও ব্যাটারদের সামনের দিকে খেলাচ্ছে। স্যুইং শেষ হচ্ছে স্টাম্পেই। এলবিডব্লিউ, কট বিহাইন্ড ও বোল্ড করার সুযোগ বাড়ছে তাতে। বাঁহাতি ব্যাটার হলে রাউন্ড দ্য উইকেট বল করছে। ডানহাতি ব্যাটার ক্রিজে গেলেই ওভার দ্য উইকেট আসছে। মানসিকভাবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। দুর্দান্ত ফলো থ্রু। দলে সুযোগ পেয়েই উইকেট তুলে আত্মবিশ্বাস পেয়ে গিয়েছে।
শামির মধ্যে কখনও কোনও কুসংস্কার দেখিনি। আগে একটা তাবিজ পরত। জানি না সেটা এখন আর আছে কি না। কোনও আংটিও দেখিনি। শুধু আইসপ্যাক নিয়ে ঘোরে। ব্যথা কমানোর জন্য। তা নিয়ে মজাও করেছি অনেক।
যত দিন যাচ্ছে, শামির বোলিংয়ের ধার বাড়ছে। ৬ ম্য়াচে ২৩ উইকেট নিয়েছে। নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ম্যাচের পরই ওকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলাম যে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। ফাইনালটা জেতাতে হবে। তারপর কথা হবে। তাতে ও ধন্যবাদ দিয়ে রিপ্লাইও করেছে। ওর ধৈর্য দেখে ভাল লেগেছে। প্রথম চার ম্যাচে খেলানো হয়নি। শামি বিশ্বের যে কোনও দলে প্রথম একাদশে সুযোগ পাবেই। অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ড, পাকিস্তান - যে কোনও দল ওকে লুফে নেবে। তবে ভারতীয় দলের কম্বিনেশনের জন্য ওকে বাইরে বসতে হয়েছিল। ও কিন্তু হাল ছাড়েনি। সুযোগ এলেই যাতে নিজেকে নিংড়ে দিতে পারে, তার জন্য তৈরি ছিলই। প্রথম ম্যাচেই চার উইকেট নিয়ে ও প্রমাণ করে দেয় যে, সাফল্যের জন্য কতটা ছটফট করছিল।
পরপর এতগুলো ভাল পারফরম্যান্স। ওয়ান ডে ক্রিকেটে এত ভাল পারফরম্যান্স আমি কোনও বোলারের দেখিনি। বল নিয়ে যেভাবে দৌড়চ্ছে... স্বপ্নের দৌড়। বাঘের মতো দৌড়চ্ছে। কী মসৃণ রান আপ। সেই সঙ্গে লক্ষ্যে অবিচল। শান্ত। সংযত।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। এখন প্রচুর উপার্জন। আইপিএলের লোভনীয় চুক্তি। জাতীয় দলের তারকা। মানুষ শামি কিন্তু একই রয়ে গিয়েছে। সব সময় আপন করে নেয়। যখনই দেখা হয়, ভীষণ মজা করি। আড্ডা দিই। শামি মাটির মানুষ। বিশ্বের এক নম্বর পেসার এখন শামিই।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন: সন্দীপ সরকার)
আরও পড়ুন: ODI World Cup Exclusive: দু'পা দৌড়ে অভিনব প্রস্তুতি, কীভাবে ব্যাটারদের আতঙ্ক হয়ে উঠলেন শামি?
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামেও। যুক্ত হোন
https://t.me/abpanandaofficial
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।