সন্দীপ সরকার, কলকাতা: ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট (BCCI) হয়েও অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন করে পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন বলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে (Sourav Ganguly) আক্রমণ করেছিলেন সিএবি-র প্রাক্তন কর্তা ও অধুনা তৃণমূল কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে (Biswarup Dey)। এবার পাল্টা বোমা ছোড়া হল সৌরভ শিবির থেকে। অভিযোগ করা হল, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের (N Srinivasan) সিমেন্ট প্রস্তুতকারী সংস্থা থেকে মাইনে নিতেন বিশ্বরূপ।


বুধবার সৌরভের পাশে দাঁড়িয়েও তীব্র কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিশ্বরূপ। অভিযোগ করেছিলেন, নিজের সুবিধার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হয়েছেন সৌরভ। সেই সঙ্গে অভিযোগ করেছিলেন, অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন করে বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদের মর্যাদা লঙ্ঘন করছেন সৌরভ।


বৃহস্পতিবার সৌরভের আপ্তসহায়ক তানিয়া ভট্টাচার্য এবিপি লাইভকে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন। লিখেছেন, 'বিশ্বরূপবাবু, আপনার লেখার মধ্যে যেমন মন খারাপের প্রতিফলন আছে, তেমনই কিছু ব্যঙ্গ দেখতে পেলাম। আপনি লিখেছেন মিস্টার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অমিত শাহর হাত ধরে তিন বছর আগেই প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বা অমিত শাহর উদ্যোগে ভারতীয়  বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিজেশ পটেল ও শ্রীনিবাসনও তো অমিত শাহর সাহায্য চেয়েছিলেন  প্রেসিডেন্ট হতে। আপনি খুব ভাল করেই জানেন কারণ আপনি শ্রীনিবাসনের পে রোলে ছিলেন বহুদিন ধরেই। সেদিন  শ্রীনিবাসন তো ব্রিজেশ পটেলকে হাত ধরে এনেছিলেন অমিত শাহর বাড়িতেই তাঁকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট করার জন্য। অমিত শাহ নিষেধ করে দেওয়ায় সেটা আর হয়নি। ব্রিজেশ পটেল নির্বাচনে দাঁড়ালেন না কেন? সাহস হল না?'


যা শুনে প্রাক্তন সিএবি কর্তা ও ক্রিকেট প্রশাসনে সৌরভ বিরোধী শিবিরের প্রধান মুখ হিসাবে পরিচিত বিশ্বরূপ এবিপি লাইভকে বললেন, 'শ্রীনিবাসন ইন্ডিয়া সিমেন্টস সংস্থার কর্ণধার। পে রোল তো দূরের কথা, ক্রিকেট প্রশাসনিক জীবনে ওঁর বা ওঁর সংস্থা থেকে এক টাকাও নিইনি। কেউ প্রমাণ করতে পারলে যা বলবে মেনে নেব।'


সৌরভ শিবির অবশ্য এখানেই থামছে না। তানিয়া বলছেন, 'শ্রীনিবাসনের মতো ক্ষমতাশালী লোক যিনি বোর্ড নির্বাচন করেছেন বহুবার, এইবারও করতেই পারতেন। কিন্তু করতে চাননি। এইবারও তো রজা বিনি, রাজীব শুক্ল বা বোর্ডের বাকি  যারা আছেন তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন তো সেই অমিত শাহর জন্যই। এর আগেও অনেকেই অরুণ  জেটলি, সনিয়া গাঁধী, শরদ পওয়ারদের বরাভয় নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিসিসিআই সচিব বা সভাপতির মতো পদ পেয়েছেন, সেটা তো আপনার অজানা নেই! তখন আপনাকে প্রতিবাদ করতে দেখলাম না বিশ্বরূপবাবু! আপনি মনে হয় তাঁদের কিছু লোকের চামচে ছিলেন।'


সৌরভকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদ থেকে যেদিন কার্যত ছেঁটে ফেলা হল, সেদিন বিশ্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়ায় লম্বা পোস্ট করেন। লেখেন, 'বছর তিনেক আগে বিজেপির হাত ধরে (পড়তে হবে অমিত শাহ-র হাত ধরে) ব্রিজেশ পটেলকে হঠিয়ে, রাতারাতি বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছিলেন সৌরভ। অথচ প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার ব্রিজেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্রিজেশের বদলে সৌরভকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট করা হয় শুধুমাত্র ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। ঠিক একইরকমভাবে আমার গুরু শ্রদ্ধেয় জগমোহন ডালমিয়ার আকস্মিক প্রয়াণের বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে নবান্নে গিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে সিএবি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন সৌরভ।' বিশ্বরূপ প্রশ্ন তোলেন, 'সিএবি নির্বাচন এড়িয়ে ঘুরপথে তখন সংস্থার প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া সৌরভের মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষে খুব মাননসই ছিল কি?'


সৌরভের আপ্তসহায়ক যা নিয়ে বলছেন, 'বিশ্বরূপবাবু তো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বাম আমলে বুদ্ধবাবু (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) বা অন্য কোনও মন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ বলেছেন দেখলাম। কিন্তু আপনি কি তাঁদের কাছের মানুষ  ছিলেন না? আপনার রেফিউজ অফিসের মেন বিল্ডিংয়ে এখনও বিরাট করে প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের নামের প্লেট লেখা আছে, তিনি কি আপনার শত্রু ছিলেন? হয়তো তখন খুব ক্ষমতা ছিল ওঁর। আর আপনার প্রয়োজন ছিল। হয়তো রেফিউজ বিল্ডিংয়ের ক্লিয়ারেন্স লাগতো আপনার...।' যোগ করেছেন, '২০১৫ সালে সৌরভ যখন সিএবি প্রেসিডেন্ট হন, আপনি তো লড়াই করতেই পারতেন। আপনাকে কেউ কি বারন করেছিল? নাকি হেরে যাওয়ার ভয়ে আপনি লড়তে চাননি? আপনার মনোনয়ন দেওয়া তো কেউ আটকায়নি। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন, কোষাধ্যক্ষ পদটাও না হারাতে হয়।'


বিশ্বরূপ প্রশ্ন তুলেছিলেন সৌরভের বাণিজ্যিক প্রচার নিয়ে। যা নিয়ে সৌরভের আপ্ত সহায়কের প্রশ্ন, 'আপনার খুব কাছের  মানুষ শ্রীনিবাসন তো সিমেন্টের ব্যবসা করেন। তিনি যখন বোর্ড বা আইসিসি-র পদে ছিলেন, সিমেন্ট কারখানা কি বন্ধ করে দিয়েছিলেন? নাকি জগমোহন ডালমিয়া তাঁর চর্মনগরী বন্ধ করেছিলেন? শরদ পাওয়ার কি তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ করেছিলেন? নাকি শশাঙ্ক মনোহর কোর্টে প্র্যাক্টিস বন্ধ করেছিলেন?' যোগ করেছেন, 'সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় স্বনামধন্য। তাই গত ২৫ বছর তিনি বিজ্ঞাপনের মুখ। বোর্ডের সভাপতি সাম্মানিক কাজ। তাই ব্যক্তিগত কাজ চালিয়ে যেতেই হয়।'


বিশ্বরূপ অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। বলছেন, 'শ্রীনিবাসনের সিমেন্ট সংস্থা বা জগমোহন ডালমিয়ার চর্ম সংস্থা পারিবারিক ব্যবসা। আমি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, স্কুল, পারিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসা নিয়ে তো প্রশ্ন তুলিনি। কারও আয়ের দরজা তো বন্ধ হতে পারে না। আমি বলেছি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদের অমর্যাদা হয় এরকম কিছু না করতে। কোথাও বলা নেই যে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাণিজ্যিক প্রচার করা যাবে না। আইনি বাধা নেই। তবে ভাবমূর্তি বলে তো একটা ব্যাপার আছে! পদে থেকে কিছু কাজ করা যায় না।'


সৌরভ শিবির অবশ্য গোলাগুলি থামাচ্ছে না। কিংবদন্তি অধিনায়কের আপ্ত সহায়ক আক্রমণের সুরে বলেছেন, 'আপনি যখন সিএবির পদে ছিলেন, আপনার রেফিউজ সংস্থার নামে প্রচুর অনুদান নিতেন। এখন আপনি কাউন্সিলর হওয়ায় নিশ্চয়ই সেই অনুদানের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে?'


বিশ্বরূপ অভিযোগ উড়িয়ে বলছেন, 'আইসিসি চেয়ারম্য়ান হওয়ার পর শতাব্দীপ্রাচীন রেফিউজ সংস্থা শ্রীনিবাসনকে নিজেদের অর্থে সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে এসে রেফিউজ সংস্থাকে প্রকাশ্যেই এক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন শ্রীনিবাসন। সেই অনুদানের বিনিময়ে রসিদও দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুদানের টাকায় ৫ হাজার স্কোয়ার ফিট জায়গায় শতবার্ষিকী ভবন তৈরি করেছে রেফিউজ। সেই অর্থে এডুকেশনাল স্কুল, ভোকেশনাল সেন্টার ও রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। ফলে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।'


ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মসনদ থেকে সরতে হচ্ছে সৌরভকে। তাঁর আইসিসি চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনাও ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। সামনে সিএবি-র বার্ষিক সাধারণ সভা। এই পরিস্থিতিতে নিজের রাজ্য সংস্থার প্রাক্তন কর্তার বাউন্সার ধেয়ে আসছে সৌরভের দিকে। যে বাউন্সার হুক করে মাঠের বাইরে ফেলতে তৎপর সৌরভ-ঘনিষ্ঠরা।