কলকাতা: সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।


দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক যোগাসন থেকে তিন-তিনটি সোনার পদক ছিনিয়ে নিয়ে সেই প্রবাদবাক্যকেই যেন সত্যি প্রমাণ করে ছেড়েছেন সুস্মিতা দেবনাথ (Susmita Rai Debnath)। কিন্তু তবু সোনার মেয়ের মুখে বিষাদের ছায়া। উদ্বেগের মেঘে ঢাকা পড়ছে সাফল্যের হাসিও।


কে এই সুস্মিতা দেবনাথ ওরফে রাই? হাওড়ার (Howrah) উদয়নারায়ণপুরের মেয়ে। যোগাসনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে দুবাইয়ের এশিয়ান যোগাসন স্পোর্টস কাপে স্বর্ণপদকের হ্যাটট্রিক করে শিরোনামে উঠে এসেছেন।


বাবা, মা ও ভাইকে নিয়ে পরিবার রাইয়ের। উদয়নারায়ণপুর মাধবীলতা মহাবিদ্যালয়ে কলাবিভাগে স্নাতক স্তরের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। যোগাসন শুরু কীভাবে? এবিপি আনন্দকে সুস্মিতা বলছিলেন, 'শিশু বয়স থেকেই ভীষণ নমনীয় আমার শরীর। পিছনের দিকে শরীর পুরোপুরি বেঁকিয়ে দেওয়া বা ভাঁজ করে ফেলার মতো যে সমস্ত কলা অনেক কসরত করে আয়ত্ত করতে হয়, বলতে পারেন আমার মধ্যে তা জন্মগত। গল্প শুনেছি যে, আমি যখন শিশু ছিলাম, মা কোমরে দড়ি বেঁধে রান্না ও সংসারের কাজ করত। আমি নাকি সেই বয়স থেকেই পুরোপুরি শরীর বেঁকিয়ে দিতে পারতাম। এরকমও হয়েছে বেশ কয়েকবার যে চেয়ার উল্টে যাওয়ার শব্দ শুনে মা দৌড়ে এসেছে। ভয় পেয়েছে যে, আমি হয়তো পড়ে গেছি। কিন্তু দেখেছে চেয়ার উল্টে গিয়েছে, আমি গ্রিল ধরে ঝুলছি। সেই বয়সেই দুপা বিপরীত দিকে সোজা ফাঁক করে মাটিতে বসে পরতাম। তখন থেকেই মা ঠিক করে নিয়েছিল যে, আমাকে যোগাসন শেখাবে।'


ছোটবেলায় মা মামণি দেবনাথ নিজেই স্ট্রেচিং করাতেন। সুস্মিতা বলছেন, 'কুর্চি বিনোদবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় জিমন্যাস্টিক্সের ক্লাস দেখে মায়ের মনে হয়েছিল, আমিও পারব। শিক্ষিকাকে বলতে তিনিও আমাকে পরখ করেন। বুঝতে পারেন যে, আমি সত্যিই পারব। তারপর ব্লক, সাব ডিভিশন স্তরে ও পরে জেলা স্তরে জিমন্যাস্টিক্সে অংশগ্রহণ করতে শুরু করি। তিন বছর এভাবেই চলে।'


প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকার পরামর্শে গ্রামের যোগাসন শিক্ষক অরূপ মান্নার কাছে ভর্তি হন সুস্মিতা। 'অরূপ স্যরের প্রশিক্ষণেই জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। কিন্তু স্যর আচমকা মারা যান। তখনও আমি জানতাম না যে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাসন প্রতিযোগিতা হয় বলে। অথচ যোগাসন নিয়ে আরও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। স্যর মারা যাওয়ায় আমার স্বপ্ন জোরাল ধাক্কা খায়,' বলছিলেন সুস্মিতা।


তারপর কলকাতায় একটি যোগাসনের শো করতে গিয়েছিলেন। সেখানে সুস্মিতার যোগাসনের পারদর্শিতা দেখে একজন তাঁর মাকে  জাতীয় স্কুল গেমসে অংশগ্রহণ করার কথা বলেন। সুস্মিতা বলছেন, 'আমরা কিছু জানতামই না যে, এরকম প্রতিযোগিতা হয়। ওই ম্যামের (রত্না) পরামর্শে ভবানীপুরে অরিন্দম স্যরের কাছে যাই। তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি আমি। অরিন্দম স্যরের কথায় আবার সাঁতরাগাছির বাকসাড়া ক্লাবে অরুণ দাসের কাছে ভর্তি হই। আমার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগত যেতে। তবু সেখানেই যেতাম সপ্তাহে দুদিন করে।' যোগ করলেন, 'অরুণ স্যরের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে নিতেই দুবার ইন্টার ইউনিভার্সিটি জাতীয় গেমসে অংশ নিই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রিপুরাতে খেলো ইন্ডিয়া গেমসে যাই। সেখানে ব্রোঞ্জ জিতি। সেটাই খেলো ইন্ডিয়া গেমসে বাংলার প্রথম পদক জয়। তবে তারই মাঝে অরুণ স্যরও মারা যান। আমার সাফল্য দেখে যেতে পারেননি স্যর।'


ফের অনিশ্চয়তায় পড়েন সুস্মিতা। তারপর কোন্নগরে গৌরাঙ্গ সরকারের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। উত্তরাখণ্ডে জাতীয় গেমসে সুযোগ পান। সুস্মিতা বলছেন, '২০২৩ সালের অক্টোবরে জাতীয় গেমসে তিনটি বিভাগে একটি করে সোনা (আর্টিস্টিক গ্রুপ), রুপো (ট্র্যাডিশনাল) ও ব্রোঞ্জ (আর্টিস্টিক সোলো) পদক জিতি।'


তারপরই দুবাইয়ে তৃতীয় এশিয়ান যোগাসন স্পোর্টস কাপ। দুবাইয়ের প্রতিযোগিতায় দশটি দেশ অংশ নিয়েছিল। ইরান, ইতালি, ভিয়েতনামের মতো দেশের প্রতিযোগীরা অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনটি স্বর্ণপদক জিতেছেন বঙ্গকন্যা। সুস্মিতা বলছেন, 'ট্র্যাডিশনাল, আর্টিস্টিক ও রিদমিক পেয়ারে সোনা জিতেছি। পাশাপাশি সব গ্রুপের সোনাজয়ীদের নিয়ে চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স রাউন্ডে রানার আপ হয়েছি।'


তবু মন ভাল নেই কৃতী কন্যার। কেন? অর্থের অভাবে বিরাট এক সুযোগ হাতছাড়া হতে বসেছে যে! সুস্মিতার কথায়, 'উত্তরাখণ্ডে জাতীয় গেমসে ভাল ফল করায় অগাস্ট মাসে শ্রীলঙ্কায় আন্তর্জাতিক যোগাসন প্রতিযোগিতার যোগ্যতা অর্জন করেছি। কিন্তু ঋণে জর্জরিত আমার পরিবার। জানি না শ্রীলঙ্কা যেতে পারব কি না।'


দুবাই সফরের জন্য প্রায় লাখ দুয়েক টাকা খরচ হয়েছে। আত্মীয়-পরিজনেরা কিছুটা সাহায্য করেছেন। নাগেরবাজারের এক সংস্থাও কিছুটা সাহায্য করে। তারপরেও উদয়নারায়ণপুরের একটি দোকানে মায়ের সোনার গয়না বন্ধক রেখে প্রায় এক লক্ষ টাকা ধার নিতে হয়েছিল সুস্মিতাকে। এদিকে, ২০ অগাস্ট থেকে শ্রীলঙ্কার প্রতিযোগিতা। রেজিস্ট্রেশনও শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে অর্থাভাবে সুস্মিতার স্বপ্ন আটকে রয়েছে। দুবাই থেকে ফেরার পর সংবর্ধনার জোয়ার। রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাও এসেছিলেন। তবে আর্থিক আনুকূল্য মেলেনি। শ্রীলঙ্কায় গেলে দেশের জন্য আরও পদক জিতবেন, বিশ্বাস সুস্মিতার। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর স্বপ্ন বিশ বাঁও জলে।


বাবা শ্যামল দেবনাথের ভাড়ার ছোটখাট দোকান। জামাকাপড়ের ব্যবসা। ভাই ক্লাস ফাইভের পড়ুয়া। সংসারের হাল ধরতে সুস্মিতা একটি ডিফেন্স সংস্থায় এনসিসি বাচ্চাদের যোগাসন শেখান। পাশাপাশি যোগাসন শেখানোর জন্য নিজের ইনস্টিটিউট খুলেছেন। কর্মসংস্থানের জন্যও কাজ করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন সুস্মিতা। একটি সংস্থা খুলতে চান, যারা বিভিন্ন স্কুলে বা ক্লাবে যোগাসনের শিক্ষক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। নীল নকশা সাজানো চলছে। 


যোগাসনের বাইরের জীবন কীরকম? কী ভাল লাগে? সুস্মিতা বলছেন, 'রিদমিক আর্টিস্টিকের জন্য নাচ শিখেছি। ভাল পারফরম্যান্সই করেছি। এছাড়া কাজ ও প্রস্তুতির জন্য সারাদিন কাটে বাড়ির বাইরে। অন্য কিছু করার ফুরসত কই!'


শ্রীলঙ্কা সফরের দিন এগিয়ে আসছে। রেজিস্ট্রেশনের সময় ফুরোচ্ছে। আর অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরছে হাওড়ার কৃতী কন্যাকে।


আরও পড়ুন: কোপা চ্যাম্পিয়ন হয়ে কত টাকা পেলেন মেসিরা? অঙ্কটা চোখ ধাঁধিয়ে দেবে


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।