গোপাল চট্টোপাধ্যায়, বীরভূম : বীরভূমে কীর্ণাহারের রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছর পেরিয়েছে । নানা কাহিনি জুড়ে আছে এই পরিবারের পুজো ঘিরে। শতকের পর শতক ধরে ঐতিহ্য মেনে এই পরিবারে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা। সময়ের স্রোতে মলিন হয়নি পুজোর জৌলুস।
দুর্গোৎসব মানেই কীর্ণাহারের রায় চৌধুরী পরিবারে আনন্দের বন্যা। এই ঐতিহ্যে কখনও ভাটা পড়েনি। শুধু এবার ভাবাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ! ইতিমধ্যেই দেবীর আবাহন হয়েছে এই পরিবারে। শুরু হয়ে গেল কীর্ণাহারে রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। তবে এখানে কোনও মূর্তির পুজো হয় না। তবে সপ্তমীর দিন থেকে দুর্গা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর ছবি পট চিত্রে তুলে ধরে পুজো করা হয়।
বোধনের দিন সকালে ঠাকুর বাড়ির কিছু দূরে পুকুর ঘাট থেকে শোভাযাত্রা করে ঘট জলে ভরে আনা হয়। বরণের পর শুরু হয় দুর্গা পুজো। রায় চৌধুরী বাড়ির সদস্য কাশীনাথ রায়চৌধুরী জানান, পুজোর নিয়ম এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আছে সন্ধিপুজো ও অন্নভোগ দেওয়ার রীতি। তবে বোধনের দিন থেকে প্রতিদিন মোট পাঁচটি বলি হত এখানে। এই প্রথা আগে চালু থাকলেও এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মহাষ্টমীতে বলিদান প্রথা চালু রয়েছে এখানে। মহাষ্টমীতে রায়চৌধুরী বাড়ির বলিদানের পর কীর্ণাহারে বেশকিছু পুজোর বলিদান হওয়ার প্রথা এখনও চালু রয়েছে।
বোধনের দিন প্রথম ঘটে জল ভরা হয়। সপ্তমীতে আরও একটি ঘটে জল ভরা হয়। বোধনের দিন থেকে কীর্ণাহারে রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোতে পরিবারের সদস্যদের আসা যাওয়া শুরু হয়ে যায়। এখানে মূর্তি পুজো না হলেও পুজোর আচার অনুষ্ঠানে কোনও ঘাটতি থাকেনা।
অন্যদিকে , বিভিন্ন বনেদি বাড়ির পুজোর মধ্যে অন্যতম হল বীরভূমের সিউড়ির বসাক বাড়ির দুর্গাপুজো। এই বছর ৬২ তম বর্ষে পদার্পণ করছে এই বাড়ির পুজো। ১৩৬৬ বঙ্গাব্দে বীরভূমের সিউড়িতে স্বর্গীয় যামিনী কান্ত বসাকের হাত ধরে শুরু হয় এই পুজো। তার আগে বাংলাদেশের ঢাকার ধামড়াই গ্রামে প্রথম শুরু হয়েছিল এই পুজো। তবে ১৩৬৬ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশ থেকে সিউড়িতে এসে ঘট স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় এখানের দুর্গাপুজো। প্রথম থেকেই এই বাড়িতে মাটির দুর্গা মূর্তি গড়ে পুজো করা হত। কিন্তু কালের নিয়মে একে একে কমেছে লোকবল। ফলে পরিবর্তন এসেছে চিরাচরিত কিছু প্রথায়। লোকবল কমে যাওয়ায় গত ২০১৭ সালে বসাক বাড়িতে স্থাপন করা হয় অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি। সেই থেকে ওই মুর্তিকেই পুজো করা হয়।
আরও পড়ুন :
সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় পুরোহিতের ভূমিকায় নন্দিনী ভৌমিক, কতটা কঠিন সেই পথ ? সমাজ কি বদলেছে ?
বর্তমানে বসাক বাড়ির পুজোর দায়িত্বে আছেন প্রয়াত যামিনী কান্ত বসাকের পৌপুত্র মলয় কান্ত বসাক ও তাঁর স্ত্রী মৌমিতা বসাক এবং বোন মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায়। তবে এই বাড়ির পুজোর জৌলুস এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। প্রত্যেকবছর বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে পারিবারিক রীতি মেনেই পুজো করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে দর্শনার্থীরা ভিড় করেন এই বাড়ির পুজোয়। যদিও গত দুই বছর ধরে চলা করোনা আবহে জাঁকজমকে খানিক ভাটা পড়েছে নিশ্চয়ই।
পঞ্চমীর দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় নানা বিধি মেনে পুজো। যেহেতু এই বাড়িতে মা মনসাও বিরাজ করেন তাই পঞ্চমীর দিনেই মা মনসার ঘট স্থাপন করা হয়। সিউড়ির বসাক বাড়িতে দেবী দুর্গা বৈষ্ণবী মা হিসেবে পূজিত হন। ফলে পুজোর কয়েকদিন গোটা পরিবারে চলে নিরামিষ খাওয়া দাওয়া। মহাষষ্ঠীতে বোধনের ঘট বসানো হয়। ওইদিন মাকে নিজেদের বাড়িতে তৈরি নাড়ু,মুড়কি, বাতাসা ভোগ দেওয়া হয়। মহাসপ্তমীতে লুচি, পায়েসের ভোগ নিবেদন করা হয়। যেহেতু এখানে মা মনসা বিরাজ করেন তাই পঞ্চমী থেকে অষ্টমী প্রতিদিনই দুধ কলাও নিবেদন করা হয়।