শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিমা গড়া । পড়েছে মাটির প্রলেপও। তবে লাহা বাড়ির দুগ্গা প্রতিমা দেখলে চমক তো লাগবেই। এই বাড়ির প্রতিমা ত্রিশূল হাতে অসুরনাশিনী নন। বরং চার ছেলেমেয়েকে সঙ্গে মা এক চালচিত্রে পূজিত হন হরগৌরি রূপে। শিব ঠাকুরের কোলের উপর অধিষ্ঠিতা গৌরি। এই পরিবারের ঈষ্ট দেবী জয় জয় মা অর্থাত্ জগজ্জননী। পুজোর ৫ দিন, জয় জয় মাও ঠাকুর ঘর থেকে নেমে আসেন। রুপোর সিংহাসনে তাঁকে স্থাপন করা হয়। মহালয়ার পর থেকেই শুরু হয় প্রসাদ তৈরি।
পরিণীতা, পিকু থেকে হালফিলের ওয়েবসিরিজ ... বাংলা থেকে বলিউড , কলকাতার আবহ প্রতিষ্ঠায় তাবড় পরিচালকরা ভরসা করেছেন উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির উল্টোদিকে অবস্থিত লাহা বাড়ির উপর। এই লাহাবাড়ির আবার ৩টি ভাগ। বড়,মেজ ও ছোট তরফের। স্বাধীনতার আগে থেকে কলকাতায় বিরাট প্রতিপত্তি লাহাদের। সেই সময় শহর কলকাতায় ব্যবসায় যে সব বাঙালি পরিবার ভালরকম সাফল্য পেয়েছিল, তার মধ্যে লাহারা অন্যতম। একটা নয়, নানারকম বাণিজ্যে ভালরকম খ্যাতি ছিল লাহাদের। আর সেসময় ধনী পরিবারগুলিতে দুর্গাপুজোর আয়োজন হত। আসলে বারোয়ারি পুজোর চল তো তেমন ছিল না। জানা যায়, লাহা পরিবারের কোনও এক বধূ স্বপ্ন পান দেবী দুর্গার অষ্টধাতুর মূর্তির। কথিত আছে, সেই মূর্তি উদ্ধার করেই প্রথম লাহা পরিবারের দুর্গাপুজোর শুরু। আগে লাহা বাড়ির পুজো হত চুঁচুড়ায়। পরে কলকাতায় এসে পুজো শুরু হয় ১৮৫৭ সালে। এখন যে বাড়িরই পালা পড়ুক না কেন, নিয়ম মানা হয় একই। জানালেন, লাহা বাড়ির প্রবীণা সদস্য অপর্ণা লাহা। ৩৫ বছর আগে বিয়ে করে যখন তিনি লাহা বাড়িতে আসেন., তখন থেকে নিয়ম মেনে পুজোর কাজে যুক্ত থেকেছেন । কখনও রীতির পরিবর্তন দেখেননি। সব লাহাবাড়িতে যাতে একই নিয়ম মানা হয়, তার জন্য একটি খাতাতে লেখা থাকে বিধি। জন্মাষ্টমীর পরদিন নন্দোত্সবে কাঠামো পুজো হয়। সেদিন গণেশ পুজো হয়। সেই গণেশই দুর্গার সঙ্গে থাকা গণেশের মূর্তির ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তৈরির সময়।
আরও পড়ুন :
জানা যায়, শ্রী মধুমঙ্গল লাহা চুঁচুড়ায় পুজো করতেন ২০০ বছরেরও অধিক কাল আগে। তবে পুজোর ইতিহাস আরও পুরনো। শিকড় ঠিক কোথা অবধি বিস্তৃত , এই নিয়ে নানা মত। অপর্ণা লাহা জানালেন, রাজা প্রাণকৃষ্ণলাহা, নবকৃষ্ণ লাহা ও শ্রীকৃষ্ণ লাহা - এই তিনতরফের বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয় যার যখন পালা পড়ে।
আরও পড়ুন :
সন্ধিপুজোর ভোগে ল্যাটা বা শোল, শুনুন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কালীকিঙ্কর ভবনের পুজোর গল্প
জানা যায়, শ্রী মধুমঙ্গল লাহা চুঁচুড়ায় পুজো করতেন ২০০ বছরেরও অধিক কাল আগে। তবে পুজোর ইতিহাস আরও পুরনো। শিকড় ঠিক কোথা অবধি বিস্তৃত , এই নিয়ে নানা মত। অপর্ণা লাহা জানালেন, রাজা প্রাণকৃষ্ণলাহা, নবকৃষ্ণ লাহা ও শ্রীকৃষ্ণ লাহা - এই তিনতরফের বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয় যার যখন পালা পড়ে।
জানা যায়, প্রতি বছর একই কাঠামোর মাটি লাগে। বিসর্জনের পর বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয় কাঠামোটি। অপর্ণা লাহা জানালেন, এই বাড়িতে এখনও মহালয়ার পরদিন অর্থাত্ প্রতিপদ থেকে ভিয়েন বসে। তারপর থেকে একের পর এক মিষ্টি তৈরি হয়। যেমন - তিলের নাড়ু, মুগের নাড়ু, ছোলার নাড়ু, মোয়া, দরবেশ, গজা, লবঙ্গলতিকা, প্যাঁড়াক্ষীর ইত্যাদি। সেই ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত। বহুপ্রকার মিষ্টি দিয়েই মায়ের ভোগ তৈরি হয়। সঙ্গে থাকে নানারকমের লুচি, কচুরি, ও ভাজা, আলু-পটল কুমড়োর ছোঁকা, মালপো , হালুয়া, বেগুনি প্রভৃতি। সে এক দেখার মতো আয়োজন। এই বাড়িতে পুজোর ৪ দিন নিরামিষ খাওয়ার রীতি। প্রতিমা বরণের পর দশমীর দুপুরে মাছ-ভাত খাওয়ার চল আছে।
আরও পড়ুন :
দশমীতে 'বাড়ির মেয়ে'কে নবমীর রাঁধা ভোগ অর্পণ, গান গেয়ে মা দুর্গাকে বিদায় জানায় চট্টোপাধ্যায় পরিবার
লাহা বাড়িতে কখনও পশুবলি হয় না। সপ্তমী, সন্ধিপুজো ও নবমীতে বলি দেওয়া হয় ছাঁচিকুমড়ো। রোজই হোম হয়। এছাড়া ধুনো পোড়ানোর রীতি বেশ আকর্ষক। বাড়ির বিবাহিত মেয়ে বা বউ, মাটির সরায় ধুনো জ্বালিয়ে দুই হাতে ও মাথায় চাপিয়ে এক মনে দেবী স্মরণ করে। অষ্টমীতে কুমারী পুজোও হয়ে থাকে ফি বছর।
এই বাড়ির বিসর্জনের রীতি বেশ অভিনব। মায়ের মূর্তি দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কুমোর দলবল বেঁধে এই কাজটি করেন। প্রতিমা বেরিয়ে গেলেই দোর দিয়ে দেওয়া হয়। যতক্ষণ না বিসর্জন করে বাড়ির কর্তা ফিরছেন, ততক্ষণ দরজা খোলা হয় না। বিসর্জন করে ফিরে এসে গৃহকর্তা জিগ্যেস করেন, মা আছে ঘরে? ভিতর থেকে বাড়ির গৃহিণী উত্তর দেন, মা আছেন ঘরে। তারপর খোলা হয় দরজা। বিসর্জনের দিন জয় জয় মা-ও ফিরে যান ঠাকুর ঘরে। এরপর একাদশী তিথিতে হয় সত্যনারায়ণ পুজো। বিজয়া করে ফিরে এসে খাওয়া হয় সিদ্ধি ও মিষ্টি। এই ভাবেই বছরের পর বছর মহাসমারোহে লাহা বাড়িতে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা।