অভিরূপ দত্ত, কলকাতা: ভাল বেতনে বেসরকারি চাকরি। নিরাপদ জীবন, দুর্দান্ত কেরিয়ারের হাতছানি। ছিল সবকিছুই। কিন্তু, স্বপ্নপূরণের জন্য সেটাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর বছরখানেকেরও বেশি চোয়ালচাপা লড়াই। সেই লড়াই সার্থক হল ২০২২ সালে এসে। ২০২১ সালের সর্বভারতীয় ইউপিএসসি (UPSC) পরীক্ষায় সারা ভারতে ৫০তম স্থান পেলেন শিলিগুড়ির বাসিন্দা অভিজিৎ রায় (Abhijit Ray)। এবিপি লাইভের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এল তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যের কিছু টুকরো মুহূর্তের কথা।


একটা গ্রামের ছবি:
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন অভিজিৎ রায়। পাশ করার পরেই বেঙ্গালুরুতে একটি প্রথম সারির সংস্থায় চাকরি (Job) পেয়েছিলেন। কেরিয়ার (Career) শুরুর প্রথম থেকেই মাটির সঙ্গেও যোগ ছিল তাঁর। যে সংস্থায় চাকরি করতেন তাদের সিএসআর (CSR) অ্যাক্টিভিটির কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্নাটকের বেশ কিছু গ্রামে গিয়েছিলেন। সেটাই মোড় ঘোরালো জীবনে। কিন্তু কীভাবে? সেটা জানাতে গিয়েই অভিজিৎ তুলে ধরলেন একটি ঘটনার কথা। তিনি বলেন, 'একবার কর্নাটকের একটা ব্লাইন্ড স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম বেসিক ফেসিলিটি নেই। কিন্তু এমন না যে, সেটা দেওয়া খুব কঠিন। অল্প দেখলেই হয়ে যাবে।' এমনই বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। তখন থেকেই ঠিক করেছিলেন এদের উন্নতির জন্য কিছু করবেন। ভাবতে ভাবতে উত্তরও মিলেছিল---সিভিল সার্ভিস।


চাকরি ছাড়ার ভাবনা:
চাকরিরত অবস্থায় প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। কিন্তু কাজের চাপের সঙ্গে এত বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি (Preparation) নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সাফল্য না আসায় চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বেঙ্গালুরুর পাট চুকিয়ে ফিরে আসেন শিলিগুড়িতে। তারপর শুধুই অধ্যবসায়ের কাহিনি। নিয়মিত পড়াশোনা, অনুশীলন। ২০২০ সালেও সামান্য একটুর জন্য সুযোগ হাতছাড়া হয়। কিন্তু এতদিনের জেদ-অধ্যবসায়ের পুরস্কার এল ২০২১ এর UPSC-তে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ৫০ নম্বরে নাম। UPSC-তে বাংলা থেকে হাতেগোনা যে কজন স্থানাধিকারী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম অভিজিৎ রায়।


পাশে ছিলেন অনেকেই:
তাঁর এই সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁর বাবা-মা, ড. মুকুল চরণ রায় এবং ড. চন্দ্রা রায়ের, জানালেন অভিজিৎ। তিনি বলেন, 'আমার বাবা স্বাস্থ্য প্রশাসনে ছিলেন, একটা ইন্সপিরেশন ছিলই।' তিনি আরও বলেন, 'ছোট থেকেই বাবা-মা সমর্থন করেছেন। চাকরি ছেড়ে প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে একটু চিন্তা করলেও পরে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছেন। মানসিক ভাবেও পাশে থেকেছেন।' এবিপি লাইভের সঙ্গে আলাপচারিতায় বারবার অভিজিতের মুখে উঠে এসেছে তাঁর পুরনো অফিসের ম্যানেজারের কথা। তাঁর কাছ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বলে জানালেন। তাঁর এই লড়াইয়ে পাশে ছিল তাঁর অনেক বন্ধুও।




প্রস্তুতির সময়টা:
শিলিগুড়ির (Siliguri) সেন্ট জোসেফ স্কুলের ছাত্র অভিজিৎ রায়। এখান থেকে পাশ করার পর দিল্লি গিয়ে উচ্চশিক্ষা। তারপরেই বেঙ্গালুরুতে চাকরি। চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন শিলিগুড়িতেই। তখন থেকে বাড়ি বসে পুরো প্রস্তুতি নিয়েছেন। কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে আলাদা করে প্রস্তুতি তিনি নেননি। অভিজিৎ জানালেন, চাকরি করার সময়েই পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তখন আলাদা করে পড়ার সময় পেতেন না। পরে যখন চাকরি ছেড়ে পড়াশোনা শুরু করলেন তখন আর সেভাবে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু নিজে নিজে পড়াশোনা করার কারণে অনেক বেশি নিয়মানুবর্তিতা অভ্যাস করতে হয়েছে। কিন্তু অনেকসময় এই লড়াইয়ে পরিবার পাশে থাকলেও তো নানা পারিপার্শ্বিক চাপ থাকে। চাকরি ছেড়ে এই পরীক্ষায় বসা নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেটাও তো অনেকের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ তৈরি করে? সেটা কীভাবে কাটানো যায়? এই প্রশ্নে দারুণ টিপস দিয়েছেন অভিজিৎ। তিনি বললেন, 'যতটা সম্ভব কম লোককে জানিয়ে এই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। তাহলেই ভাল।'


কীভাবে পড়াশোনা:
পড়াশোনা শুরু আগে মানসিক প্রস্তুতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে জানাচ্ছেন তিনি। কারণ UPSC-এর প্রস্তুতি বছরখানেক ধরে চলে। সময় লাগে, ধৈর্যও লাগে। ফলে মাঝপথে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেছেন তিনি। কিন্তু আলাদা করে নির্দিষ্ট সময় ধরে পড়তেন না তিনি। তাহলে কীভাবে পড়াশোনা? অভিজিৎ রায় বলেন, 'আগের রাতেই প্ল্যান করে রাখতাম, পরদিন কী কী পড়ব। সেই প্ল্যান অনুযায়ী সেই বিষয়টা শেষ করতাম।' তার জন্য যতটা সময়ই লাগুক, কাজটা শেষ করার দিকেই লক্ষ্য থাকত তাঁর।


স্পেশাল টিপস:
ঝুঁকি নিয়ে চ্যালেঞ্জ। তারপর তুখোড় ফল। রাজ্যে যাঁরা ইউপিএসসি নিয়ে আগ্রহী, যাঁরা প্রশাসক হতে চান। তাঁদের কাছে নিজেই এখন অনুপ্রেরণা শিলিগুড়ির অভিজিৎ রায়। এবিপি লাইভের কথায় তাঁদের জন্য টিপস দিলেন তিনি। তিনি জানান, কেন পরীক্ষাটি দিচ্ছি? কেন এই কাজে যোগ দিতে চাই? এই প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে। কীভাবে পরীক্ষা হয়, তা বুঝে নিজের মতো করে পড়াাশোনার রুটিন সাজিয়ে নিতে হবে। বিশেষ করে নিজের উপর প্রেশার হ্যান্ডেল করা খুব গুরুত্বপূর্ণ, অভ্যাস করতে হবে উত্তর লেখার পদ্ধতি। তিনি বলেন, 'এতবড় পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য কোনও নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি হয় না। এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম স্ট্র্যাটেজি কাজ করে। নিজের শক্তি বুঝে সেভাবেই ঠিক করতে হবে।'
 
ভাবনা হোক নিরপেক্ষ:
অভিজিতের মতে, যখন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে UPSC ক্র্যাক করতেই হবে, আসল প্রস্তুতি তখন থেকেই শুরু হয়। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, স্থির সিদ্ধান্ত, কোনও প্ল্যান করলে সেটা শেষ করা-এভাবেই টুকরো টুকরো পদক্ষেপ জুড়েই বড় সাফল্য আসে। দেশ-বিদেশ-রাজ্যে ঘটে চলা সব ঘটনার বিষয়েই গভীরভাবে জানতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই সমস্ত ঘটনা নিরপেক্ষভাবে বোঝা ও দেখার অভ্যাস করা এবং সেভাবেই উত্তর লেখার অনুশীলন করা, বলছেন অভিজিৎ রায়। 


আরও পড়ুন: ব্যর্থতাই সাফল্যের সিঁড়ি, ক্লাস টুয়েলভ ইকনমিকসে ফেল করেও আজ IAS


Education Loan Information:

Calculate Education Loan EMI