কলকাতা: কাক ডাকা ভোরের আলোয় এক দিকে রেডিওয় (radio) বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ,অন্য দিকে গঙ্গার (ganges) ঘাটে তর্পণ। বাঙালি মাত্রেই চোখ বন্ধ করে বলে দেবেন,দিনটি মহালয়া (mahalaya)। পুজোর (durga puja) ঢাকে কাঠি পড়তে আর কয়েকটি দিন। হোয়াটসঅ্যাপ (whatsapp) থেকে ফেসবুক (facebook) ও ট্যুইটারে (twitter) 'শুভ মহালয়া' (wish) বার্তার জোয়ার। কিন্তু দিনটি কি আদৌ শুভ? শাস্ত্র কী বলছে?
মহালয়ার উৎস সন্ধানে...
হিসেব মতো মহালয়া মানে পিতৃপক্ষ শেষ,দেবীপক্ষ শুরু। ওই দিন পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে জল ও পিণ্ড দানের রীতি বহু প্রাচীন। এই নিয়ে রামায়ণ ও মহাভারতে দু'রকম গল্পও রয়েছে। রামায়ণ অনুযায়ী, ত্রেতাযুগে লঙ্কাজয়ের আগে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার উপাসনা করেছিলেন। সেই শারদীয়া দেবীবন্দনা শাস্ত্রমতে 'অকাল বোধন' হিসেবে পরিচিত। হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী,যে কোনও শুভ কাজের আগে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করতে হয়। কথিত রয়েছে, লঙ্কাজয়ের আগে শ্রীরামচন্দ্রও এক কাজ করেছিলেন। সেখান থেকেই শারদীয়া দুর্গোৎসবের আগে মহালয়া তর্পণের শুরু বলে একাংশের বিশ্বাস। মহাভারতের কাহিনিটি আবার কিছুটা অন্য রকম। সেখানে জানা যায়,কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অঙ্গরাজ কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা পরলোকগমন করলে তাঁকে খাবার হিসেবে সোনা ও রত্ন দেওয়া হয়। দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে ইন্দ্র জানান,দানবীর কর্ণ সারাজীবন সোনা ও রত্ন করেছেন। কিন্তু কখনও প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জল বা খাবার দেননি। তাই তাঁকেও স্বর্গে সোনা-ই খাবার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কর্ণ জানিয়েছিলেন,তাঁর পিতৃপুরুষ সম্পর্কে কিছু জানতেন না। তাই জল ও খাবার দিতে পারেননি। তখন ১৬ দিনের জন্য কর্ণকে পিতৃলোকের উদ্দেশে জল ও অন্ন দেওয়ার জন্য মর্ত্যে ফেরানো হয়। এই সময়টাই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত যার শেষ দিন মহালয়া। কিন্তু এর পরও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, মহালয়া কি আদৌ শুভ দিন?
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারি বললেন,'অনেকে এটিকে অশুভ মনে করেন ঠিকই, কিন্তু এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। শাস্ত্র বলছে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে পিতৃপক্ষ শুরু। মহালয়া তার শেষ দিন। তবে এই দিনটির বিশেষ কিছু তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত সনাতন ধর্ম অনুযায়ী এই দিনে শুধু পিতৃপুরুষ নন, জাতি-ধর্ম-ভাষানির্বিশেষে জগৎ সংসারের সকলকে তর্পণ করা যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, চেনাজানার বাইরেও সকলকে তর্পণ করা যায় এই দিনে। ফলে এই দিনটি মহৎ যার সঙ্গে মহালয়া শব্দটির সুস্পষ্ট যোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত,তর্পণ একধরনের তৃপ্তি দেয়। যিনি তর্পণ করছেন, তিনিও তৃপ্ত হন। আর তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী, যাঁদের উদ্দেশে তর্পণ, সেই পূর্বপুরুষদের আত্মারাও তৃপ্তি পান। আর তৃপ্তি একটি এমন মানবিক বৃত্তি যা ইতিবাচকতা তৈরি করে। ফলে এর মধ্যে কোনও অশুভ কিছু নেই।'
কার্যত একমত সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক কনাদ সিংহ। বললেন,'দিনটি পিতৃপুরুষকে তর্পণ করার দিন। ফলে এটিকে আলাদা করে অশুভ ভাবার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, যে কেউ যে কোনও দিন কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন যদি না সেই দিনটি বিশেষ কোনও কারণে শোকের দিন হয়।' কিন্তু শাস্ত্র নিয়ে যাঁদের চর্চা, তাঁদের একাংশ তর্পণের এই দিনটিকে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের তিথি হিসেবে মনে করেন। তাই তাঁদের মতে এটি 'শুভ'বলে গ্রাহ্য করা উচিত নয়। অধ্যাপক সিংহ অবশ্য এই মত মানতে চান না। তাঁর যুক্তি,'সকলে তর্পণে বিশ্বাস করেন না। এটাও মানতে চান না যে ওই দিনে পূর্বপুরুষদের আত্মা প্রেতলোক থেকে উত্তরপুরুষদের পাওয়া জল ও পিণ্ড পেয়ে সন্তুষ্ট হন। ফলে এই দিনটি আলাদা করে অশুভ ভাবার কোনও কারণ নেই।' তবে ওই দিনেই 'মহিষাসুরমর্দিনী'-র সম্প্রচার যে বাঙালি চেতনায় দুর্গাপুজোর সঙ্গে মহালয়াকে মিলিয়ে দিয়েছে,সেটাও বললেন কনাদ।
এ প্রসঙ্গে অনেকেই মহালয়া কথাটির অর্থ মনে করান। মহালয়ার অর্থ 'মহৎ আলয়'। এই আলয়ের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। শাস্ত্র নিয়ে যাঁদের চর্চা, তাঁদের একাংশ মনে করেন এই আলয়ের অর্থ 'বাস'। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী,বছরের এই সময়টি সূর্যের দক্ষিণায়ন চলে। এই সময় তিনি তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী সংজ্ঞার সঙ্গে থাকেন। পিতৃপক্ষের শেষ দিনে তাঁর সেই 'মহৎ আলয়'-এর কাছাকাছি পৌঁছন সকল পূর্বপুরুষরা, এমনই মনে করেন অনেকে। সেখান থেকেই মহালয়া। সে দিক থেকেও দিনটি অশুভ নয়, বললেন অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারি।
অর্থাৎ আগমনী সুর, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের চণ্ডীপাঠ,গঙ্গার ঘাটে, বিশ্বাস, এমনকী অবিশ্বাস--সবটা নিয়েই 'শুভ' মহালয়া,বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন:আপাতত আন্দোলন প্রত্যাহার করল আদিবাসী কুড়মি সমাজ, উঠল রেল অবরোধ