অমিতাভ রথ, ঝাড়গ্রাম: কংক্রিটের জঙ্গলে সবুজের দেখা মেলাই দুষ্কর আজকাল। ঘটা করে বৃক্ষরোপণ, সবুজায়নের শপথ নিলেও, কথা এবং কাজে ফারাক থেকে যায় আকাশ-পাতাল। কিন্তু মন থেকে চাইলে কিছুই অসম্ভব নয়, ফের প্রমাণ হলে এই বাংলাতেই। ছোট থেকে গাছপালার মধ্যে বড় হয়ে, সবুজের বুকেই শান্তির আশ্রয় গড়ে তুললেন এক যুবক (Jhargram Tree House)।
মন থেকে চাইলে কিছুই অসম্ভব নয়, ফের প্রমাণ হলে এই বাংলাতেই
কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম, দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটারের বেশি (Jhargram News)। চার-সাড়ে চার ঘণ্টা লাগে পৌঁছতে। তাই বলে শহুরে ছোঁয়া যে একেবারেই গায়ে লাগেনি, তা নয়। জায়গায় জায়গায় বসেছে মোবাইল টাওয়ার। শপিং মলের সংস্কৃতিও পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু আধুনিকতাকে গ্রহণ করেও, অত্যন্ত যত্নসহকারে শহুরে হাওয়া গায়ে লাগাননি এক যুবক।
ঝাড়গ্রাম জেলার বেলাপাহাড়ির অন্তর্গত জয়পুর গ্রাম। সেখানেই বাস বরুণ দাসের। তাঁর বাড়ির আয়তন টেনেটুনে ৮০০ স্কোয়্যার ফুট। কিন্তু চারপাশ একেবারে উন্মুক্ত। বাড়ি ঘিরে রয়েছে কমপক্ষে ৭০টি গাছ। ছোট থেকে সেই গাছের ছায়াতেই থেকেছেন বরুণ। খেলে বেরিয়েছেন মাঠেঘাটে।
শান্ত, স্নিগ্ধ এবং নিরিবিলি সেই পরিবেশই মনে গেঁথে যায় বরুণের। সেখানেই নিজের জগৎ গড়ে তুলবেন ভেবে নিয়েছিলেন সেই ছোট্ট বয়সেই। বিশেষ করে টেলিভিশনে ‘ছোটা ভীম’ দেখে যজ্ঞুকে মনে ধরে যায় তাঁর, যার কিনা বাড়ি দেখানো হয়েছিল গাছের উপরে। তিলে তিলে সেই স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করেছেন বরুণ।
আরও পড়ুন: Raina Shoot-out : ওষুধ কিনতে আসছিলেন, তৃণমূল কর্মী ও তাঁর বাবাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি !
সেই কাজে বরুণ সহায়ক হয়ে ওঠে অতিমারি। লকডাউনে গোটা পৃথিবী যখন অবরুদ্ধ, মুক্ত মনে কাজ শুরু করেন দেন বরুণ। ধীরেসুস্থে গাছের মগডালে বানিয়ে ফেলেন আস্ত ঘর। সেই ঘর এখন হয়ে উঠেছে বরুণের স্টাডি রুম। তবে শুধু একলা ব্য়বহার করেন না, গ্রামের কচিকাঁচাদেরও আস্তানা হয়ে উঠেছে মগডালের ওই ঘর।
বরুণ জানিয়েছেন, ছোট থেকেই গাছের উপর ঘর তৈরির স্বপ্ন ছিল তাঁর। লকডাউনে মোবাইল সংযোগে সমস্যা দেখা দেয়। অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। তাতেই নিজের ভাবনা কার্যকর করতে নেমে পড়েন। ঘর তৈরির জন্য শক্তপোক্ত গাছ বেছে নেন। তার পর তিনটি মোটা গাছের ডালে বাঁশ, কাঠ পর পর সাজান। দড়ি দিয়ে বেঁধে উপরে চাপান খড়। ঘরের মেঝেয় চাটাই পেতেই কাটছে আপাতত।
মগডালে তৈরি ওই ঘরে ওঠার জন্য রয়েছে বাঁশের সিঁড়ি। ছোট্ট একটি দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। রয়েছে জানলাও, হাওয়া চলাচলের জন্য। বৃষ্টি এলে ত্রিপল ফেলে দিতে হয়। ঘরে রয়েছে আলোর ব্যবস্থাও। যখন থাকেন না, তালা ঝুলিয়ে দেন বরুণ।
বরুণ জানিয়েছেন, গত দু’বছর ওই স্টাডি রুম চাকরির প্রস্তুতিতে খুব কাজে লেগেছে তাঁর। সেখান থেকেই অনলাইন ক্লাস করেছেন। গ্রামের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনার জন্য ওই ঘরে ভিড় করত। এখনও যাতায়াত রয়েছে তাদের। মোবাইলের টাওয়ার পেতে সমস্যা হলেও, ভিডিও গেম খেলতে এই ঘরই ভরসা কচিকাঁচাদের। ছুটির দিন প্রায় সারাদিনই সেখানে কাটে তাদের।
গ্রামের কচিকাঁচাদেরও আস্তানা হয়ে উঠেছে মগডালের ওই ঘর
ইন্টারনেটে দেখা ঝাঁ চকচকে ‘ট্রি হাউস’-এর মতো ধোপদুরস্ত না হলেও, একাহাতে যা তৈরি করেছেন, তাতেই খুশি বরুণ। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে শিলদা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। পাস করেছেন বিএডও। আপাতত গ্রামে রাস্তার পাশে একটি তেলেভাজার দোকান চালান। ওই ঘর থেকে অন্য কাজকর্মও সারেন তিনি। আবার একা থাকতে ইচ্ছা হলেও, আশ্রয় নেন সেখানেই।