বিটন চক্রবর্তী, তমলুক: সতীর একান্নপীঠের অন্যতম পীঠ তমলুকের দেবী বর্গভীমা। পুরাণ মতে এখানে দেবীর বাম পায়ের গুম্ফ অর্থাৎ গোড়ালি পড়েছিল। তমলুকের এই বর্গভীমা মন্দির প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে নানান অলৌকিক কাহিনি।
কথিত আছে, তমলুকের ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজত্বে প্রত্যেকদিন জ্যান্ত মাছের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এলাকার ধীবরদের। সেই মতো, এক ধীবর রমণী রোজ জ্যান্ত শোল মাছের যোগান দিয়ে আসছিলেন রাজপরিবারে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন ওই ধীবর রমণী লক্ষ্য করেন তাঁর জিয়ানো সবকটি মাছ মরে গেছে। তখন তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে, মনের দুঃখে বনের মধ্যে বসে কাঁদতে শুরু করে দেন।
কিছুক্ষণ পর সেখানে এক মহিলা এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন 'কি হয়েছে?' তখন ধীবর রমণী জানান তাঁর সমস্যার কথা। এরপর ধীবর রমনীকে সেই মহিলা বলেন, সামনে কিছুটা এগোলে যে বন পড়বে, সেখানে একটি জলের কুণ্ড রাখা আছে। সেই জল যদি মাছের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মাছগুলি ফের জ্যান্ত হয়ে যাবে।
পাশাপাশি এই কথা রমণী যাতে ঘুণাক্ষরে কাউকে না বলেন, সে কথাও জানিয়ে দেন সেই মহিলা। তৎক্ষনাৎ ধীবর রমণী তা করে হাতেনাতে ফল পান।
আরও পড়ুন: কালী পুজোর দিন মহাকালী রূপে পূজিত হন দেবী কঙ্কালী
এবার থেকে তিনি রোজ রাজাকে জ্যান্ত শোল মাছ দিয়ে আসতে লাগলেন। বেশ কিছুদিন পর রাজার মনে সন্দেহ জাগে। রোজ কি করে ধীবর রমণী এইভাবে জ্যান্ত মাছের যোগান দিয়ে চলেছে।
এমনকি অসময়েও একইভাবে জ্যান্ত মাছের যোগানের রহস্যটা কী, তা জানতে ধীবর রমণীকে চাপ দিতে থাকেন রাজা। প্রথমে ধীবর রমণী কিছু বলতে না চাইলেও, তাঁকে ভয় দেখিয়ে জোর করে রাজা আসল সত্যিটা জেনে নেন। রাজা ঠিক করেন, তিনি নিজেই একবার হাতেনাতে পরীক্ষা করে দেখবেন।
সেই মতো ওই ধীবর রমণীকে নিয়ে রাজা জলের কুণ্ডের কাছে গেলে দেখতে পান, জলের কুণ্ড নেই, সেখানে পড়ে রয়েছে একটি পাথরের ওপর শিলাখণ্ড।
সেই দিন রাজা স্বপ্নাদেশে দেবীকে দেখতে পান। তারপর রাজা সেখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজকে দেবী বর্গভীমারুপে পরিচিত। সেই পাথরের ওপর শিলাখণ্ড, আজও দেবীমূর্তি হিসেবেই পূজিতা হন। আর সেই থেকেই আজও দেবী বর্গভীমার ভোগের অন্যতম পদ শোলমাছের টক।
মন্দীরের পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। কথিত আছে সেই পুকুরে ডুব দিয়ে যে যা হাতে পেতেন তা মন্দিরের পাশে যে কেলিকদম্ব বা কাট কলকে গাছ রয়েছে, সেখানে সুতো দিয়ে বেঁধে দিতেন মনস্কামনা করে। মনস্কামনা পুরণ হলে তাঁরা পুজো দিয়ে যান।
তবে এই তমলুক এলাকা বর্গীহামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি। তবে বর্গীরা এই মন্দির ধ্বংশ করতে এসে পিছপা হন। পরে তাঁরাও এখানে পুজো দেন।
কালাপাহাড় মন্দির ধ্বংস করতে এসে দেবীর পদতলে আশ্রয় নিয়ে ক্ষমাভিক্ষা চান। এমনকি তমলুকের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রুপনারায়ণ নদ সমস্ত কিছুকে গ্রাস করলেও কোনওপ্রকার ক্ষতি হয়নি মন্দিরের।
কালিপুজোর দিন দেবী বর্গভীমার বিশেষ পূজার্চনার ব্যবস্থা করা হয়। মন্দিরের অন্যতম সেবাইত, অয়ন অধিকারী জানালেন, ওই দিন মাকে রাজবেশ পরানো হয়। তন্ত্রমতে এখানে পুজো হয়। ভোগে শোলমাছ ছাড়াও পাঁচ রকমের মাছ, পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচরকমের তরকারি দেওয়া হয়। এছাড়া, ভাত, পোলাও, ফ্রায়েডরাইস, খিচুড়ি, নানান পদের মিষ্টি প্রভৃতি থাকে।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার শক্তির একমাত্র দেবী ছিল এই বর্গভীমা। অর্থাৎ দেবী বর্গভীমা ছাড়া আর কোনও শক্তির দেবতার পুজো হত না। পরবর্তীকালে পুরোহিতদের বিধান অনুযায়ী, আগে দেবী বর্গভীমার পুজো দিয়ে তবেই অন্য পুজো শুরু করা যাবে।
জেলাজুড়ে আজ সে প্রথা তেমনভাবে না থাকলেও, আজও তমলুক শহরের বারোয়াড়ি দুর্গাপুজা বা কালী পুজোর আগে দেবী বর্গভীমার পুজো দেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: আভিজাত্য, আড়ম্বরের মেলবন্ধন নয়, বিরহের যন্ত্রণা জ্বালা নিয়ে পূজিতা হন মা
এমনকি কালীপুজোর দিন সন্ধ্যেবেলায় রীতিমতো শোভাযাত্রা করে তমলুকের সমস্ত বারোয়াড়ি পুজো উদ্যোক্তারা দেবী বর্গভীমার পুজো দিয়ে তারপর তাঁরা পুজো শুরু করেন।
দেবী বর্গভীমাকে নিয়ে অলৌকিক নানান কাহিনি থাকলেও ঐতিহাসিক দিক থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মন্দিরের আরেক সেবাইত সমীরণ অধিকারী বলেন, 'অবিভক্ত মেদিনীপুর জুড়ে যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ, তখন তমলুকে এসেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি বিপ্লবীদের সঙ্গে বৈঠক করার আগে, দেবী বর্গভীমার কাছে আন্দোলনের সাফল্য কামনায় পুজো দিয়ে তারপর তিনি তার কর্মসূচিতে অংশ নেন।'
তবে শুধুমাত্র কালীপুজো কিংবা দুর্গাপুজোয় নয়, দেবী বর্গভীমা সারা বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছেন। এখনো বহু দূর-দূরান্ত ভক্তরা ছুটে আসেন মায়ের টানে।
করোনাকালে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে, মন্দিরে প্রবেশের ক্ষেত্রে। গর্ভগৃহে গিয়ে আগে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও করোনা আবহে এখন তা বন্ধ।
তবে এখনও ভক্তরা সকাল সন্ধে দেবী বর্গভীমাকে দর্শন করতে পারবেন দূর থেকে। পুজো দেওয়া যাচ্ছে। দূরত্ববীধি মেনে কুপন কেটে ভোগ খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে মন্দির কর্তৃপক্ষ।