কলকাতা: কোপাইয়ের চরে হাওয়ার গতিপথ বদল হয়েছে বার বার। কিন্তু বিগত দু’দশকে বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডলের (Anubrata Mandal) দাপটে চিড় ধরেনি।২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে জেলায় জেলায় যখন গেরুয়া দাপট অনুভূত হচ্ছে, তার মধ্যেও বীরভূমে (Birbhum) তৃণমূলের (TMC) পতাকা নামতে দেননি তিনি। স্বভাবতাই ‘কেষ্ট’র প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) স্নেহে ঘাটতি পড়েনি। এমনকি বীরভূমের মাটি থেকে দলের হয়ে নির্বাচনী স্লোগান ‘খেলা হবে’র সুর বেঁধে দিয়েছিলেন অনুব্রতই। গরুপাচার মামলায় (Cattle Smuggling Case) সিবিআই-এর (CBI) হাতে গ্রেফতার (Anubrata Mandal Arrested) হওয়ার পর বীরভূমে নতুন খেলার সূচনা হচ্ছে বলে রব তুলতে শুরু করেছে বিরোধীরা। কিন্তু অনুব্রতকে নিয়ে এখনও কড়া অবস্থান নিতে নারাজ তৃণমূল। অনুব্রতর প্রতি মমতার অপত্য স্নেহই এর নেপথ্যে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।


দু’দশক ধরে বীরভূমে অনুব্রতর দাপট অক্ষুণ্ণ


রাজনীতিতে হাতেখড়ির আগে অনুব্রত কখনও মুদির দোকানে কাজ করেছেন, কখনও আবার মাছও বিক্রি করেছেন বলে শোনা যায়। মমতা যুব কংগ্রেসের নেত্রী থাকাকালীনই তাঁর সংস্পর্শে আসা অনুব্রতর। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেডে় বেরিয়ে এসে মমতা যখন তৃণমূল গড়লেন, সেই সময় বীরভূমে দলের সভাপতি করা হয় সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আর জেলায় যুব তৃণমূলের দায়িত্ব পান অনুব্রত। নানুর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে মমতা যখন আন্দোলন গড়ে তুলছেন, সেই সময় তাঁর সিপিএম-এর বিরুদ্ধে তাঁর সেনাপতির ভূমিকায় ছিলেন অনুব্রতই। তিনি যেমন ‘দিদি’ বলতে অজ্ঞান, তেমনই ‘কেষ্ট’র উপর প্রগাঢ় হয় দলনেত্রীর স্নেহ।তাই চোখ বন্ধ করে অনুব্রতর হাতেই বীরভূম ছেড়ে দেন মমতা।


তবে বীরভূমে দাপট যত বেড়েছে, ততই বেশি করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন অনুব্রত। কখনও পুলিশকে বোমা মারার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। বিরোধীদের ‘শুঁটিয়ে লাল’ করে দেওয়া থেকে ‘চড়াম চড়াম’, ‘নকুলদানা’ বিলি, কখনওই মুখে কুলুপ আঁটতে দেখা যায়নি তাঁকে। তাতে বার বার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। বীরভূমে অনুব্রতর দাপেটর কথা অজানা নয় বিরোধীদেরও। তাই নির্বাচনে তাঁকে ঘরবন্দি করার পক্ষে একযোগে সমর্থন জানাতে দেখা যায় সকলকে। কিন্তু নজরবন্দি থেকেও কী ভাবে মোটরসাইকেলে চেপে ভোট দেখতে বেরিয়ে পড়েন অনুব্রত, তার কিনারা করতে ঘাম ছুটে যায় নির্বাচন কমিশনেরও।


আরও পড়ুন: Anubrata Mandal Arrested: বীরভূমের জন্য স্বাধীনতা দিবস! অনুব্রতর গ্রেফতারিতে মন্তব্য অনুপমের, বললেন, ‘খেলা সবে শুরু’


তার পরেও আগাগোড়া অনুব্রতর পাশে থাকতে দেখা গিয়েছে মমতাকে। যে কোনও কারণে যখনই বিপাকে পড়েছেন কেষ্ট, কার্যত ঢাল হয়ে এগিয়ে এসেছেন তিনি। নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেন, ‘‘কেষ্ট সংগঠন ভাল করে।’’ ভোটের বাজারে অনুব্রত নজরবন্দি হলে মমতাকে বলতে শোনা যায়, ‘‘কেষ্টর উপর ওদের অনেক রাগ। প্রতি বার নির্বাচনের আগে কেষ্টকে নজরবন্দি করে রেখে দিচ্ছে। এ বার যদি এরকম কিছু করে তো তুমি কোর্টে যাবে, প্রোটেকশন নেবে। এ ভাবে নজরবন্দি করে রাখা যায় না।’’ তাই যখনই বিপদে পড়েছেন অনুব্রত, খোদ মমতা তাঁকে অক্সিজেন জোগাতে নেমে পড়েন বলে অভিযোগ বিরোধীদের।


তবে মমতার এই অপত্য স্নেহ অকারণ নয় বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরাও। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুব্রতর আত্মজীবনী প্রকাশের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন খোদ রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘চাইলেই আমাদের সঙ্গে এক তালিকায় যুক্ত হতে পারতেন অনুব্রত। মুখ্যমন্ত্রীর এতটাই কাছের উনি যে, চাইলে সব পেতে পারতেন। কিন্তু উনি সেটা করেননি। কারণ বীরভূমের আকাশ, বাতাস, জল, তারা ওঁকে বলেছে যে অনুব্রত মণ্ডল একটি মাত্র জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবেন না। বলেছে, অনুব্রত তুমি বিশ্বাসের মধ্যে নির্বিশেষ। তাই নিজের দফতর বা রাজ্যসভায় কোনও পদে তাঁকে বেঁধে ফেলা অর্থহীন।’’


পদ নয়, মমতার সৈনিক হিসেবেই থাকতে চান অনুব্রত


তিনি দলের কর্মী, মাঠেঘাটে সংগঠনে অভ্যস্ত, কোনও পদ বা মন্ত্রিত্ব তাঁর সইবে না বলে জানিয়েছিলেন খোদ অনুব্রতও। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘দেলর সাধারণ ক্রমী আমি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক। রাজ্যসভায় পাঠাতে চেয়েছিলেন উনি। কিন্তু, আমি জানিয়ে দিই, দলই ছেড়ে দেব। মানুষের সঙ্গে কাজ করতে চাই। কোনও ভাঁওতাবাজিতে যাব না। মন্ত্রী বা সাংসদ, বিধায়ক হতে চাই না আমি।’’ অনুব্রতর এই মানসিকতাই তাঁকে মমতার প্রিয়পাত্র করে তোলে বলে মনে করা হয়। তাই ক’দিন আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারির পর তৃণমূল ‘লজ্জিত’ বলে বিবৃতি দিলেও, অনুব্রতর গ্রেফতারিতে তা বলার পরিসর নেই বলে দাবি দলের নেতাদের।