কলকাতা: অতীতে এই জায়গার পরিচিতি ছিল রাঢ় অঞ্চল বলেই। মগধ, মৌর্য থেকে শুরু করে কুশন, গুপ্ত... অনেক রাজ্যপাট দেখেছে এই জেলা, সাক্ষী হয়েছে ইতিহাসের। একসময়, শশাঙ্ক রাজার রাজত্বকালে, এই অঞ্চলটি গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি এটি দখল না করা পর্যন্ত এটি পাল ও সেনবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। কিন্তু শুধুই কি ইতিহাস? নাহ.. এই জেলা যেমন ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ, তেমনই শিল্পাঞ্চল হিসেবে এই জেলা পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে। প্রাকৃতিক সৌন্দ্যর্য্যের ছোঁয়ায়, শিল্পের উন্নতিতে, ইতিহাস বুকে নিয়ে এই জেলা তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। নাম- পশ্চিম বর্ধমান (Paschim Bardhaman)।
ইতিহাস
দুর্গাপুরের কাছে বীরভানপুরে যে মাইক্রোলিথ পাওয়া গিয়েছে, তা খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে প্যালিওলিথিক/মেসোলিথিক যুগে,অজয় উপত্যকায় বসতিগুলি ইতিহাসের কথা বলে। আদি ঐতিহাসিক যুগে বর্ধমান ছিল রাড় অঞ্চলের একটি অংশ। মগধ, মৌর্য থেকে শুরু করে কুশন, গুপ্ত... অনেক রাজ্যপাট দেখেছে এই জেলা। শশাঙ্ক রাজার রাজত্বকালে, এই অঞ্চলটি গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি এটি দখল না করা পর্যন্ত এটি পাল ও সেনবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। প্রথমদিকে মুসলিম শাসকরা গৌড় বা লখনৌতি থেকে বাংলার প্রধান অংশগুলির উপরে রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতেই। আইন-ই-আকবরীতে সরকার শরীফাবাদের একটি মহল অথবা পরগনা হিসাবে উল্লেখ করা হয় বর্ধমানকে। বিভিন্ন বইতে দামোদর ও অজয় নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি গোপভূম নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সদগোপ রাজারা শাসন করেছিলেন। কাঁকশা সিডি ব্লকের শায়মারূপার গড় এবং ইছাই ঘোষের দেউলের উল্লেখ রয়েছে। ১৬৮৯ সালে, বর্ধমান রাজ পরিবারের রাজা কৃষ্ণরাম রায় ঔরঙ্গজেবের থেকে ফরমান (রাজার আদেশ) পান। সেই ফরমান অনুযায়ী তাঁকে বর্ধমানের জমিদার করা হয়েছিল এবং তখন থেকেই এই রাজ পরিবারের ইতিহাস এবং জেলার ইতিহাস অভিন্ন হয়ে ওঠে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়ের পরে, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামসহ বর্ধমান জেলাটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ক্রাউন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে দেশটির প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭৬৫ সালে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বর্ধমানের দেওয়ানি অর্জন করে, তখন এটি বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি এবং বীরভূমের তৃতীয়াংশ দ্বারা রচিত হয়েছিল। সেসময়ে বর্ধমান জেলায় ৬টি মহকুমা নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ১৮৪৬ সালে বুদবুদ, কাটোয়া, রানীগঞ্জ, জাহানাবাদ (পরবর্তীকালে আরামবাগ) এবং ১৮৪৭ সালে বর্ধমান সদর এবং ১৮৫০ সালে কালনা। ১৯০৬ সালে রানীগঞ্জ মহকুমা আসানসোল মহকুমায় পরিবর্তিত হয়। তখন বর্ধমান জেলায় ২২ টি থানা ছিল। পরবর্তীতে জাহানাবাদকে বর্ধমানের বাইরে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৮ সালে আসানসোল মহকুমা থেকে দুর্গাপুর মহকুমা আলাদা করা হয়। একদিকে কৃষি অপরদিকে শিল্প অপূর্ব আর সম্পূর্ণ এক মেলবন্ধন নিয়ে ছিল বর্ধমান জেলা। পরবর্তীকালে শিল্প এবং কৃষির নিরিখে ভাগ করে দেওয়া হয় বর্ধমান জেলাকে। কৃষিপ্রধান জেলা হয় পূর্ব বর্ধমান। শিল্প প্রধান জেলা হয় পশ্চিম বর্ধমান। ৭ এপ্রিল, ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় পশ্চিম বর্ধমান জেলার পথ চলা।
অবস্থান
পশ্চিম বর্ধমান জেলার অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল২৩.৬৮° উত্তর ৮৬.৯৮° পূর্ব । সমুদ্র সমতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ৯৭ মিটার (৩১৮ ফুট)। জেলাটিতে দুটি মহকুমা রয়েছে। আসানসোল ও দুর্গাপুর। জেলার মোট আয়তন: ১৬০৩ বর্গ কিমি। জেলায় মোট ব্লকের সংখ্যা ৮টি। বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পূর্ব বর্ধমান, এই চার জেলা ঘিরে রয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলাটিকে। পাশেই রয়েছে ঝাড়খণ্ডও।
ভূ-পরিচয়
১৬০৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পশ্চিম বর্ধমান জেলা। দু'নম্বর জাতীয় সড়ক যা বর্তমানে ১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক হিসেবে পরিচিত এবং ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক এই জেলার বুক চিরে চলে গিয়েছে। মূলত আসানসোল এবং দুর্গাপুর এই দুই মহকুমা নিয়েই পশ্চিম বর্ধমান জেলা। আসানসোল পুরসভার ১০৬ টি ওয়ার্ড ও দূর্গাপুর পুরসভার ৪৩ টি ওয়ার্ড রয়েছে এই জেলায়। নটি বিধানসভা ১৬টি থানা ও আটটি ব্লক নিয়েই গড়ে উঠেছে এই পশ্চিম বর্ধমান জেলা। প্রায় ২৯ লক্ষ জনবসতি এই পশ্চিম বর্ধমান জেলায়। সাক্ষরতার হার প্রায় ৮০ শতাংশ। দুটি পুরসভা ছাড়াও ৬২টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে এখানে। পশ্চিম বর্ধমান জেলার উত্তরদিকে বয়ে চলেছে অজয় নদ ও দক্ষিণদিক দিয়ে বয়ে চলেছে দামোদর। এই দুই নদীর মধ্যবর্তী অংশেই ছোট্ট জেলা পশ্চিম বর্ধমান। এই জেলা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের তৈরি শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত।
অর্থনীতি
১৯৫০ ও ষাটের দশকে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ব কলকারখানা গড়ে ওঠে এই আসানসোল ও দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে। পরবর্তীকালে বেশ কিছু বেসরকারি শিল্প কলকারখানাও গড়ে ওঠে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পাঞ্চলেষ একদিকে কোল ইন্ডিয়ার কয়লাখনি ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেড রয়েছেই, অন্যদিকে, বেশ কিছু সরকারি এবং বেসরকারি শিল্প কলকারখানা পশ্চিম বর্ধমান জেলায় গড়ে উঠেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এই জেলারই অন্তর্গত আসানসোল মূলত রেলকেন্দ্রিক পুরনো শহর। আসানসোল পূর্ব রেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিভিশন। মূলত শিল্পাঞ্চল হওয়ার ফলে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই কারখানা ও অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। চাষবাস বা অন্যান্য পেশা এই অঞ্চলে সীমিত।
রাজনীতি
এই জেলায় দুটি লোকসভা আসানসোল এবং বর্ধমান দুর্গাপুর। আসানসোল লোকসভা তৃণমূলের দখলে। এখানকার সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা। বর্ধমান দুর্গাপুর বিজেপির দখলে। এখানকার সাংসদ সুরিন্দর সিংহ আলোয়ালিয়া। ৯টি বিধানসভার মধ্যে তিনটি বিজেপির দখলে ও ৬টি তৃণমূলের দখলে। জেলাতে বেশ কিছু শিল্প কলকারখানা থাকায় এখানে শ্রমিক সংগঠনের প্রভাব রয়েছে। তবে সেখানে কেবল বিজেপি এবং তৃণমূল নয়, প্রভাব রয়েছে সিপিআইএমের শ্রমিক সংগঠনেরও।
উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা
এই জেলার ক্ষেত্রে যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো সরকারি বাস ও ট্রেন পরিষেবা। কলকাতা ছাড়াও অন্যান্য জেলা সদরেও এই আসানসোল এবং দুর্গাপুর থেকে সরকারি দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বাস পাওয়া যায় প্রতিদিন। এছাড়াও ট্রেন পরিষেবায় হাওড়া এবং শিয়ালদার সঙ্গে আসানসোল দুর্গাপুরের যোগাযোগ অত্যন্ত ভাল। কাজী নজরুল ইসলাম বিমানবন্দরটি জেলার অভ্যন্তরেই রয়েছে। জেলায় দুটি বড় রেল স্টেশন রয়েছে, আসানসোল রেল স্টেশন এবং দুর্গাপুর রেল স্টেশন। সড়কপথে এই জেলায় আসতে চাইলে কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের দূরত্ব ১৭৩ কিলোমিটার। এনএইচ ১৯ ধরে আসলে সময় লাগবে ৪ ঘণ্টার একটু কম। কলকাতা থেকে আসানসোলের দূরত্ব ২১৩ কিলোমিটার। নএইচ ১৯ এবং এএইচ ১ ধরে এলে সময় লাগবে সাড়ে ৪ ঘন্টার একটু বেশী।
পর্যটন
ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য থেকে শুরু করে বিনোদন, পশ্চিম বর্ধমানের বুকে রয়েছে এমনই জানা অজানা সব ভ্রমণের জায়গা। পশ্চিম বর্ধমান এলে প্রথম যে জায়গায় যেতেই হয়, সেটি হল গড় জঙ্গল। গড় জঙ্গল হিন্দু পূরাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর মহকুমার কাঁকসা সিডি ব্লকে (দুর্গাপুরের কাছে) অবস্থিত। মেধাস মুনির আশ্রম এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অপর একটি পরিচিত জায়গা হল ইছাই ঘোষের দেউল। ইছাই ঘোষের দেউল, টাওয়ার মন্দির (রেখা-দেউল) নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় গুরুত্বের স্মৃতিস্তম্ভের তালিকা অনুসারে, ইছাই ঘোষ মন্দির একটি এএসআই তালিকাভুক্ত স্মৃতিস্তম্ভ। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান চুরুলিয়া এই জেলার মধ্যেই। কবির স্ত্রী প্রমীলা দেবীর সমাধিস্থলও রয়েছে এই জেলাতেই। কবির অনেকগুলি পাণ্ডুলিপি, পদক এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গ্রামের নজরুল একাডেমীতে সংরক্ষিত আছে। এখানে একটি কবির নামে কলেজও রয়েছে। এখানে নজরুল আকাডেমি ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আন্দাজ করা হয়, প্রাচীনকালে চুরুলিয়ায় একটি দুর্গ ছিল। এটি ষোড়শ শতাব্দীতে আফগান সর্দার শের খানের হাতে পড়ে। গ্রামের একটি স্তূপকে, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ধারণ করে বলে মনে করা হয়। মুসলিম শাসনকালে চুরুলিয়ায় একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। মাইথন বাঁধটি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মধ্যে পড়লেও ধানবাদ থেকে এটি বেশ কাছে। কাজেই পশ্চিম বর্ধমান এলে ঘুরে যেতে পারেন মনোরম এই পরিবেশে। ধানবাদ থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটি। ঘাঘর বুড়ি মন্দির আসানসোল শহরের উপকণ্ঠে ভারতের জাতীয় রাজপথের পাশে অবস্থিত। এই মন্দিরে মূলত মা কালী পূজিত হন। এটি আসানসোলের প্রাচীনতম মন্দির।
অন্যান্য
কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বা ইতিহাস নয়, শিল্পাঞ্চল হওয়ার ফলে এই জেলার অর্থনৈতিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না কখনোই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে তুলনামূলকভাবে নবীন এই জেলা। ছোট্ট ছুটিতে এই জেলা হতেই পারে আপনার মন ভাল করার ডেস্টিনেশন।
তথ্যসূত্র: https://paschimbardhaman.gov.in/bn/