সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: আজ ফলহারিণী কালী পুজো (Phalaharini Kali Puja)। জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা (Amavasya) তিথিতে এই পুজো করা হয়। ‘ফলহারিণী’ নামেই প্রকাশ যিনি ফল হরণ করেন। অর্থাৎ এই তিথিতে পুজো করলে দেবী ভাল-মন্দ সকল কর্মফল হরণ করে ইপ্সিত বা অভীষ্ট ফল ও মোক্ষ বা পারমার্থিক ফল প্রদান করেন। 


প্রাচীন আর্য সমাজ ব্যবস্থায় নারীর উচ্চ আসন স্বীকৃত ছিল। সে সময়ের ভারতীয় ইতিহাসে গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপালা, খনার মত বিদুষী নারীরা শিক্ষার জোরে সমাজে পুরুষের সমকক্ষ সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে মূলত মধ্যযুগে পুরুষতন্ত্রের দাপটে মহিলারা সমাজে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। গৃহকোণে তাঁদের ঠাঁই হয়। আধুনিক ভারতীয় সমাজের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ঘটেছিল একেবারে নিভৃতে, অতি অনাড়ম্বরে। যা পরবর্তীকালের সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থানে গভীর রেখাপাত করে।



শ্রীরামকৃষ্ণের ষোড়শী পুজো ভারতীয় সমাজের এক যুগান্তকারী ঘটনা


১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৩ই জ্যৈষ্ঠ ফলহারিণী কালী পুজোর দিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমা সারদাদেবীকে সাক্ষাৎ ষোড়শী জ্ঞানে পুজো করলেন। এটি পৃথিবীর অধ্যাত্মিক ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জগতের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা যেমন তুলনাবিহীন তেমনি আপামর পৃথিবীবাসীর কাছে দাম্পত্যের এক যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গী রাখলেন তিনি। গৃহে রমণীদের স্থান কোথায় এবং তাদের প্রকৃত স্বরূপ কি তা চেনালেন শ্রীরামকৃষ্ণ।


সেই পুজোয় পূজ্য ও পূজক ছাড়া আর কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। পরবর্তী কালে স্বামী সারদানন্দের লেখা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গে সেদিনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘সন ১২৮০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের অর্ধেকের উপর গত হইয়াছে। আজ অমাবস্যা, ফলহারিণী কালিকাপূজার পুণ্যদিবস। সুতরাং দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আজ বিশেষ পর্ব উপস্থিত। ঠাকুর শ্রীশ্রীজগদম্বাকে পূজা করিবার মানসে আজ বিশেষ আয়োজন করিয়াছেন। ওই আয়োজন কিন্তু মন্দিরে না হইয়া তাঁহার ইচ্ছানুসারে গুপ্তভাবে তাঁহার গৃহেই হইয়াছে। পূজাকালে দেবীকে বসিতে দিবার জন্য আলিম্পনভূষিত একখানি পীঠ পূজকের আসনের দক্ষিণপার্শ্বে স্থাপিত হইয়াছে। সূর্য অস্তগমন করিল, ক্রমে গাঢ় তিমিরাবগুণ্ঠনে অমাবস্যার নিশি সমাগতা হইল। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয়কে অদ্য রাত্রিকালে মন্দিরে দেবীর বিশেষ পূজা করিতে হইবে, সুতরাং ঠাকুরের পূজার আয়োজনে যথাসাধ্য সহায়তা করিয়া সে মন্দিরে চলিয়া যাইল এবং রাধাগোবিন্দের রাত্রিকালে সেবা-পূজা-সমাপনান্তর দীনু পূজারী আসিয়া ঠাকুরকে ঐ বিষয়ে সহায়তা করিতে লাগিল। দেবীর রহস্যপূজার সকল আয়োজন সম্পূর্ণ হইতে রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। শ্রীমতী মাতাঠাকুরানীকে পূজাকালে উপস্থিত থাকিতে ঠাকুর ইতঃপূর্বে বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তিনিও ঐ গৃহে এখন আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর পূজায় বসিলেন।
 
পূজাদ্রব্যসকল সংশোধিত হইয়া পূর্বকৃত্য সম্পাদিত হইল। ঠাকুর এইবার আলিম্পনভূষিত পীঠে শ্রীশ্রীমাকে উপবেশনের জন্য ইঙ্গিত করিলেন। পূজা দর্শন করিতে করিতে শ্রীমতী মাতাঠাকুরানী ইতঃপূর্বে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং কি করিতেছেন, তাহা সম্যক না বুঝিয়া মন্ত্রমুগ্ধার ন্যায় তিনি এখন পূর্বমুখে উপবিষ্ট ঠাকুরের দক্ষিণভাগে উত্তরাস্যা হইয়া উপবিষ্টা হইলেন। সম্মুখস্থ কলসের মন্ত্রপূত বারি দ্বারা ঠাকুর বারংবার শ্রীশ্রীমাকে যথাবিধানে অভিষিক্তা করিলেন। অনন্তর মন্ত্র শ্রবণ করাইয়া তিনি এখন প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করিলেন - 
 
“অয়ি বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরসুন্দরি, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, ইহার (শ্রীশ্রীমার) শরীরমনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর!”
 
অতঃপর শ্রীশ্রীমার অঙ্গে মন্ত্রসকলের যথাবিধানে ন্যাসপূর্বক ঠাকুর সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে তাঁহাকে ষোড়শোপচারে পূজা করিলেন এবং ভোগ নিবেদন করিয়া নিবেদিত বস্তুসকলের কিয়দংশ স্বহস্তে তাঁহার মুখে প্রদান করিলেন। বাহ্যজ্ঞানতিরোহিতা হইয়া শ্রীশ্রীমা সমাধিস্থা হইলেন। ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে সম্পূর্ণ সমাধিমগ্ন হইলেন। সমাধিস্থ পূজক সমাধিস্থা দেবীর সহিত আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে মিলিত ও একীভূত হইলেন।  কতক্ষণ কাটিয়া গেল। নিশার দ্বিতীয় প্রহর বহুক্ষণ অতীত হইল। আত্মারাম ঠাকুরের এইবার বাহ্যসংজ্ঞার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা গেল। পূর্বের ন্যায় অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া তিনি এখন দেবীকে আত্মনিবেদন করিলেন। অনন্তর আপনার সমস্ত সাধনার ফল এবং জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব শ্রীশ্রীদেবীপাদপদ্মে চিরকালের নিমিত্ত বিসর্জনপূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন---
 
“হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরুপে, হে সর্বকর্মনিষ্পন্নকারিণি, হে শরণদায়িনি ত্রিনয়নি শিব-গেহিণি গৌরি, হে নারায়নি, তোমাকে প্রণাম, তোমাকে প্রণাম করি”।
 
পূজা শেষ হইল - মূর্তিমতী বিদ্যারূপিণী মানবীর দেহাবলম্বনে ঈশ্বরীর উপাসনাপূর্বক ঠাকুরের সাধনার পরিসমাপ্তি হইল - তাঁহার দেব-মানবত্ব সর্বতোভাবে সম্পূর্ণতা লাভ করিল।’


১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালী পুজোর দিন শ্রীমা সারদাদেবীকে ষোড়শীরূপে পুজো করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে প্রথমেই সারদা দেবীকে সঙ্ঘ জননী বলে ঘোষণা করলেন।  ১৯০১ সালে স্বামীজী দুর্গা পুজো করলেন বেলুড় মঠে। পুজোর সংকল্প করা হল সারদা দেবীর নামে। আজও রামকৃষ্ণমঠ ও মিশনে প্রতিটি কেন্দ্রে শ্রীশ্রী মা সারদা দেবীর নামেই সংকল্প করে দুর্গা পুজো করা হয়। এমনকি প্রতি ফলহারিণী অমাবস্যায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিটি কেন্দ্রে ষোড়শী পুজোও করা হয়। 


ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবী রূপে সারদাকে পুজো করে তাঁর সমস্ত সাধনার ফল তাঁকে অর্পণ করেছিলেন। আর এই ঘটনার মধ্যে গিয়ে নারী জাতীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যে উচ্চ আদর্শ তিনি গড়ে তুলেছিলেন পরবর্তী কালে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্ম দিয়ে তারই ফলিত রূপ জগৎ কে দেখালেন।


 


আরও পড়ুন, ফলহারিণী কালীপুজোয় কেতুর দশা, শুভযাত্রা-শুভকর্মের যোগ কি রয়েছে?