অরিন্দম সেন, আলিপুরদুয়ার: টোটো ভাষার (Toto Language) শব্দকে বাংলা ও ইংরেজিতে অনুবাদ। জীবন সায়াহ্নে নিজের ভাষাকে আরও বেশি জনপ্রিয় এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে টোটো ভাষার 'অভিধান' সৃষ্টি করে এবার নজির গড়লেন টোটোপাড়ার ভক্ত টোটো। 


টোটো ভাষাকে বাংলা-ইংরেজিতে অনুবাদ


টোটো ভাষায় কথা বললেও ছিল না তাঁদের ভাষার  লিপি। সেই ভাষার লিপি তৈরি করে কিছুদিন আগেই টোটোপাড়ার ধনিরাম টোটো আজ সর্বজনখ্যাত। মিলেছে দেশের 'পদ্মশ্রী' পুরষ্কারও। এবার সেই টোটো ভাষার শব্দকে বাংলা ও ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন টোটোপাড়ার বাসিন্দা পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী ভক্ত টোটো। যা এক কথায় ডিকশেনারিও বলা যায়। যদিও 'ডিকশেনারি' বা 'অভিধান' বলতে আপত্তি তাঁর। তাঁর কথায়, 'এটা অনেকটা ওয়ার্ড বুকের মতো শব্দ ভান্ডার।'



১২০০ শব্দের বেশি বাংলা ও ইংরেজি অর্থ


 চলতি বছরের আগষ্ট মাসে কলকাতার ভাষা সংসদ দ্বারা প্রকাশিতও হয়েছে তাঁর এই অভিধান, যার নাম 'টোটো শব্দ সংগ্রহ।'  যেখানে প্রায় ৮৮ পৃষ্টার ১২০০ শব্দের বেশি বাংলা ও ইংরেজি অর্থ রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যদিও টোটো ভাষার শব্দগুলোকে বাংলা লিপিতেই ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর এই সৃষ্টিতে। যেমন, 'কুং' শব্দের বাংলা 'আমার' এবং ইংরেজিতে ' My' হবে। এই বাংলা লিপি ব্যাবহারের কারণ হিসেবে ভক্ত টোটোর দাবি, 'টোটো লিপি বলে এতদিন কিছুই ছিল না। শুধুই বংশানুক্রমে মুখে মুখে চলে এসেছে এই ভাষা। বর্তমানে তাঁরই প্রতিবেশী পদ্মশ্রী ধনিরাম টোটো এই লিপির সৃষ্টি করলেও তা আয়ত্ত্বে আনতে পড়াশোনার দরকার। কিন্তু, বহু আগে থেকে তিনি ধীরে ধীরে এই অনুবাদের কাজ শুরু করায়, তা এই অভিধানে সংযোজন করা এই মুহুর্তে সম্ভব ছিল না', বলে দাবি ভক্ত টোটোর। 


পেশায় ব্যাঙ্ক কর্মী ভক্ত টোটো, চাকরির পাশাপাশি কবিতা, গল্প লেখা ছিল তাঁর নেশা


উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট ব্লকের টোটোপাড়ায় জন্ম ভক্ত টোটোর। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারির পর কোচবিহারের দিনহাটার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর আবার জোড়াইয়ের একটি স্কুল থেকে ১৯৮১সালে মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। তিনিই টোটো উপজাতির মধ্যে দ্বিতীয়জন হিসেবে সেই সময় মাধ্যমিক পাস করেছিলেন। যদিও বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক দিলেও অকৃতকার্য হন বলে জানা গিয়েছে। তবে এরপরেই ব্যাঙ্কের চাকুরিতে যোগদান করেন ভক্ত টোটো। বর্তমানে নিজের গ্রামের এক ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ ব্যাঙ্ক শাখা থেকেই অবসরের মুখে। 



টোটো জনজাতি নিয়ে চর্চা করা গবেষকদের সাহা্য্যও করতেন তিনি


চাকরির পাশাপাশি কবিতা, গল্প লেখা ছিল তাঁর নেশা। সেই কারণেই টোটো জনজাতি নিয়ে চর্চা করা গবেষকদের সাহা্য্যও করতেন তিনি। আর গবেষকদের সেই টোটো ভাষা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা। আক্ষেপ ছিল সবার মতো নিজেদের ভাষার লিপি না থাকা। যদিও টোটো ভাষার লিপি না থাকলেও সেই শব্দগুলো বাংলা বা ইংরেজি লিপিতে ব্যাবহার করে লেখার কাজ অনেক বেশি সহজ হবে বলে তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল।


আরও পড়ুন, স্মোককাণ্ডে বাংলা-সহ ৬ রাজ্যে তদন্তে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল


'এখানেই থেমে থাকছি না'


পাশাপাশি, টোটো জনজাতির বর্তমান প্রজন্ম বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজি মাধ্যমেই এখন পড়াশোনায় অভ্যস্ত হচ্ছে। ফলে টোটো ভাষার সেই শব্দগুলোর যদি বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদ জানা থাকে, তাহলে যেমন নব প্রজন্ম উপকৃত হবে তেমনি সাধারণ মানুষও আগ্রহ দেখাবে টোটো ভাষায় প্রতি। আর সেটাই জীবন সায়াহ্নে তৃপ্তির হবে, বলে জানান ভক্ত টোটো। তাঁর কথায়,  'এখানেই থেমে থাকছি না। এভাবেই আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে চাই এই শব্দ ভান্ডারকে। এমনকি এর সঙ্গে টোটো ভাষার লিপিও জুড়ে দেবার প্রচেষ্টা থাকবে', বলে জানান টোটো জনজাতির এই অভিভাবক ভক্ত টোটো।