সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমনাথ মিত্র: আঠেরো বছর বয়সের দুঃসাহসের কথা লিখেছিলেন কবি। নিজেকে দিয়ে তা প্রমাণ করলেন স্মরণ্যা ঘোষ (Smaranya Ghosh)। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সপ্তম স্থানাধিকারী। সংসদের বিবৃতিতে কৃতী ছাত্রী হিসেবেই উঠে এসেছেন তিনি। কিন্তু সেইটুকুই যে তাঁর পরিচয় নয়, বুঝিয়ে দিলেন স্মরণ্যা (WB HS Results 2023)। তাঁর মেধা নিয়ে যখন সরগরম চারপাশ, সেই সময়ই নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে জানিয়ে দিলেন, জন্মসূত্রে স্মরণ্য ছিলেন তিনি, এখন স্মরণ্যা। পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত করেছেন নিজেকে (Transgender)।
ফি বছর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলঘোষণা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে কত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসতে হয়েছে, তা তুলে ধরেন কৃতী ছাত্রীরা। কিন্তু যে দেশে যৌনশিক্ষা নিয়ে মাথাব্যাথাই নেই কারও, সেই দেশে থেকে, মেধাতালিকায় নাম থাকা কৃতী ছাত্রী সমাজের চোখে চোখ রেখে নিজের লিঙ্গ পরিচয় জাহির করবেন, এমন অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত হয়নি বঙ্গবাসীর। কিন্তু যা হয়নি , তা যে কখনও হবে না, মান্ধাতা আমলের সেই চিন্তার গোড়াতেই কোপ বসালেন স্মরণ্যা।
জনাই ট্রেনিং হাইস্কুলের ছাত্রী স্মরণ্যা। বয়স ১৮। কলাবিভাগে পড়াশোনা। এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সপ্তম স্থান অধিকার করেছেন। সবমিলিয়ে ৪৯০ নম্বর পেয়েছেন স্মরণ্যা। বাংলায় ৯৪, ইংরেজিতে ৯৫, অর্থনীতিতে ৯৭, ভূগোলে ৯৯, ইতিহাসে ১০০ এবং ঐচ্ছ্বিক বিষয়ে ৯৯ পেয়েছেন। উচ্চমাধ্যমিক সংসদের তরফে তাঁর লিঙ্গ পরিচয় আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি যদিও। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা মেধাতালিকায় কোনও রূপান্তরিত নারীর জায়গা পেয়েছেন বলে আগে কখনও শোনা যায়নি বাংলায়।
তাই চারিদিকে মেধাতালিকায় জায়গা পাওয়াদের নিয়ে যখন হইহই রইরই কাণ্ড চলছে, তখন ঘরের কোণে, নিভৃতে যুদ্ধজয়ের হাসিই ফুটে ওঠে স্মরণ্যার চোখেমুখে। সংবাদমাধ্যম যখন পৌঁছয় তাঁর কাছে, নিজের লিঙ্গ পরিচিতি তুলে ধরেন খানিকটা যুদ্ধজয় ঘোষণার ভঙ্গিতেই। জানিয়ে দেন, পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি। আগামী দিনে রূপান্তরকামীদের পাশে থাকতে চান, তাঁদের হয়ে কাজ করতে চান, সমাজে রূপান্তরকামীদের নিয়ে গড়ে তুলতে চান সচেতনতা।
আরও পড়ুন: Mother-Son HS : ছেলের সঙ্গে একইসঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক, বেশি নম্বর পেয়ে মন খারাপ মায়ের
এবিপি আনন্দের ক্যামেরা যখন তাঁর কাছে পৌঁছয়, পুঁইমেটুলি রংয়ের সালোয়ার কামিজে বাড়িতে ছিলেন স্মরণ্যা। কথাবার্তায় কোনও রকম জড়তা ছিল না। পড়াশোনাটা যে ভালবেসেই করতে চান, জানিয়ে দেন। ঈশ্বরে বিশ্বাসী স্মরণ্যা জানান, রূপান্তরকামী হিসেবে ঈশ্বরের কাছ থেকেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তি পেয়েছিলেন তিনি।
স্মরণ্যার বক্তব্য, “আমি নিজে রূপান্তরিত নারী। আজকের দিনেও সমাজে রূপান্তরকামীদের শোষিত হতে হয়। আইন প্রণয়ন হলেও, পাল্টায়নি মানুষের মানসিকতা। এ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে চাই আমি। সিভিল সার্ভিসে যেতে চাই। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে ভারতের সব নাগরিক যাতে সুষ্ঠ ভাবে বাঁচতে পারেন, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সংজ্ঞা যাতে সার্থক করে তোলা যায়, এগোতে চাই সেই লক্ষ্যেই।”
নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয়েছে স্মরণ্যাকে। কিন্তু এই লড়াইয়ে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাশে পেয়েছিলেন বলেই নিজের নারীসত্ত্বা উদযাপন করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। স্মরণ্যা জানিয়েছেন, পুরুষের শরীর নিয়ে জন্ম হলেও, ছোট থেকেই মনে মনে নারী ছিলেন তিনি। কাউকে বলতে না পেরে মনোকষ্টে ভুগতেন। প্রথমে বন্ধুদের কাছেই নিজের রূপান্তরকামী পরিচয় খোলসা করেন স্মরণ্যা। তার পর মা-বাবা, স্কুল সকলে জানতে পারেন।
স্মরণ্যার বাবা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা গৃহশিক্ষিকা। মূর্তি বানাতে, ছবি আঁকতে ভালবাসেন স্মরণ্যা। তাঁর রূপান্তরকামী পরিচয় জানতে পেরে বরাবর পাশে থেকেছেন বাবা-মা এমনকি ঠাকুমা-ঠাকুরদাও। একাদশ শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়ে, প্রথম বার নিজের নারী পরিচয় প্রকাশ্যে আনেন স্মরণ্যা। প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে সালোয়ার পরতে শুরু করেন। তিনি যাতে অসহজ বোধ না করেন, তার জন্য স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও যথেষ্ট সাহায্য় করেছেন বলে জানিয়েছেন স্মরণ্যা।
জনাই ট্রেনিং হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রজত কুমার কুন্ডু জানান,স্বরন্যা ঘোষ খুব ভালো ছাত্রী হিসেবে অনেকগুলো উদাহরণ রেখেছে। একটা সময় ও দারুন সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেছে , কিন্তু সেটা ও সবথেকে ভালো করে সামলে নিয়ে যেভাবে রেজাল্ট করেছে তাতে আমরা খুব আনন্দিত।।
জনাই ট্রেনিং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রজতকুমার কুন্ডু বলেন, “ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত ভাল স্মরণ্যা। একটা সময় নিদারুণ সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজেই সামলেছে সব। যে ভাল রেজাল্ট করেছে, আমরা সকলেই তাতে আনন্দিত।” স্কুলের শিক্ষিকা তাপসী পণ্ডিত বলেন, “ওকে নিয়ে খুব গর্ববোধ হচ্ছে আমাদের। খুব ভাল ব্যবহার ওর।”
এই দীর্ঘ লড়াইয়ে মেয়ের পাশে থেকেছেন স্মরণ্যার মা-বাবা। মা দেবস্মিতা ঘোষ বলেন, “পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মালেও, মনে মনে ও নারী ছিল। নিজেকে আর রাখতে পারল না। আমদের অনেক বোঝায়। স্কুলেও কথা বলে। আমরাও বুঝতে পারি। এখন নারী হিসেবেই বাঁচছে। আশেপাশের সকলেই বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। রূপান্তরিত হওয়ার জন্য তেমন কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি ওকে। সকলেই মোটামুটি সহযোগিতা করেছেন।”
২০২১-এ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়নি যেহেতু, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাই প্রথম বোর্ড পরীক্ষা ছিল স্মরণ্যার। সসম্মানে শুধুমাত্র তাতেই উতরে যাননি স্মরণ্যা, সমাজ জীবনের প্রথম পরীক্ষাও মাথা উঁচু করেই পার করলেন। সেই কোন কালে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখে গিয়েছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়/পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা/এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়/আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা’। ঝুঁকি জেনেও, বিরাট দুঃসাহস বুকে নিয়ে মাথা তোলার স্পর্ধা দেখালেন স্মরণ্যা।
Education Loan Information:
Calculate Education Loan EMI