বেঙ্গালুরু: দুঃসময় যে আগে কখনও আসেনি তেমন নয়। কিন্তু ২০১৪-র পর থেকে লাগাতার যে ভাবে গ্রাফ নামতে দেখা গিয়েছে, আগে কখনও তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি কংগ্রেস। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী জোটে নেতৃত্বদান নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সেই আবহে হিমাচলপ্রদেশের পর কর্নাটক স্বস্তি দিল কংগ্রেসকে। সেখানে বিজেপি-কে শুধু পিছনেই ফেলেনি, বরং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার গড়তে চলেছে তারা। এই পট পরিবর্তনে রাহুল গাঁধীর (Rahul Gandhi) ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র (Bharat Jodo Yatra) গুরুত্ব অনস্বীকার্য বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের (Karnataka Election Results 2023)।


২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে সংসদে আসনসংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনই লাগাতার একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। তার আঁচ থেকে রক্ষা পাননি রাহুল। দলের বিক্ষুব্ধরাই বার বার প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নিয়ে। সেই আবহেই গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সূচনা করেন রাহুল। ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩-এর ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত পায়ে হেঁটে, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পেরোন রাহুল। দক্ষিণ থেকে রাহুলের এই যাত্রা শুরু হওয়ারই সুফল মিলেছে কর্নাটকে, মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।


কর্নাটকে জয়ের নেপথ্যে রাহুলের 'ভারত জোড়ো যাত্রা'!


কর্নাটকে মোট তিনটি পর্যায়ে পদযাত্রা করেন রাহুল। ২১ দিনে পেরোন ৫১১ কিলোমিটার পথ। কর্নাটকে রাহুল প্রবেশ করতেই তাঁকে নিয়ে উৎসাহের বাঁধ ভাঙে। মোট সাতটি লোকসভা এবং ২০টি বিধানসভা কেন্দ্র হয়ে এগোয় তাঁর পদযাত্রা। শুধু নিরাপত্তার বেষ্টনে থেকে হাত নাড়েননি রাহুল, ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। একরত্তিকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন কখনও। কখনও আবার বুকে টেনে নিয়েছেন শতচ্ছিন্ন কাপড়ে থাকা, ক্রন্দনরত বৃদ্ধাকে। আবার তাঁকে দেখে চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি ছেলে থেকে বুড়ো।


কর্নাটকে রাহুলকে ঘইরে এমন প্রতিক্রিয়া আরও জোর পায়, যখন অসুস্থ শরীরে পদযাত্রায় পা মেলান কংগ্রেস নেত্রী, রাহুলের মা সনিয়া গাঁধী। অসুস্থ মাকে বার বার গাড়িতে থাকতে অনুরোধ জনান রাহুল। কিন্তু ছেলের পাশেই হাঁটর সিদ্ধান্ত নেন সনিয়া। পদযাত্রায় আগাগোড়া সনিয়ার দিকে কড়া নজর ছিল রাহুলের। চলতে চলতে যখন জুতের ফিতে খুলে গিয়েছে সনিয়ার, মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে যত্ন সহকারে বেঁধে দিয়েছেন রাহুল। মা-ছেলের এই সাধারণ মুহূর্তও অসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছে ক্যামেরায়। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।


আরও পড়ুন: Karnataka Election Results 2023: উপুড় হয়ে মাথা ঠুকলেন বেদিতে, চোখবন্ধ করে একমনে প্রার্থনা, কর্নাটকে চাকা গড়াতেই মন্দিরে প্রিয়ঙ্কা


বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই দক্ষিণের রাজ্যটিকে পদযাত্রায় রাখা হয়েছিল বলে যদিও দাবি উঠেছে। কংগ্রেসের তরফে তা খারিজ করা হয়। কিন্তু কর্নাটকে এমন প্রতিক্রিয়া পাবেন, তা রাহুলও কল্পনা করতে পারেননি। কংগ্রেস যে একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি, আবেগ একই রয়েছে, শুধু একটু ঝাঁকানি দেওয়া দরকার, তা ঠাহর করতে পেরেছিলেন তিনি। সোজাসাপটা সেকথা জানিয়েওছিলেন। রাহুলের এই অকপট স্বীকারোক্তিই আরও বাড়িয়ে তোলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। তাই মাণ্ড্য দিয়ে যখন এগোচ্ছিলেন রাহুল, মানুষের মুখে বার বার ফিরে এসেছিল দেশ গঠনে কংগ্রেস তথা গাঁধী পরিবারের অবদানের কথা, কর্নাটকে কংগ্রেসের চালু করা জমি ভূমি সংস্কার আইন, যাতে জমির উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণ মানুষের।



রাহুলের এই পদযাত্রাই কর্নাটকে হৃত জমি উদ্ধারে কংগ্রেসের সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়, যেই কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান ডিকে শিবকুমার, সিদ্দারামাইয়া, রণদীপ সুরজেওয়ালা এবং সর্বোপরি কর্নাটকের ভূমিপুত্র, জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গেরা। রাহুল চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে এই উৎসাহ হাওয়ায় না মিলিয়ে যায়, কোনও কসুর রাখেননি তাঁরা। রাহুল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দক্ষিণের রাজ্যটিতে উড়ে যান প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরাও। নির্বাচনী কৌশল রচনা থেকে প্রচারের ছক, সবেতে সমান যোগদান ছিল তাঁর। এমনকি ভিতরে ভিতরে সমীক্ষাও করা হয়। সাধারণ মানুষের ওজর, আপত্তি, অভাব, অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখে, সেই মতো তৈরি করা হয় নির্বাচনী ইস্তেহার। বাড়ির মহিলাদের হাতে কাঁচা টাকা পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা হয় তাতে, যা বিজেপি-র চিন্তা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।


আরও পড়ুন: Karnataka Election Results 2023: কর্নাটক হাতছাড়া বিজেপি-র? কংগ্রেস এগিয়ে ১১৪ আসনে, এগোচ্ছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার দিকে


তবে রাহুলের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ থেকেই এর সূচনা হয় বলে মানছেন কংগ্রেস নেতৃত্বও। তাই শনিবার গণনা চলাকালীন, ভোচবাক্স যত উপচে পড়তে থাকে, ততই রাহুলের কথা বার বার ফিরে আসে সকলের মুখে। এমনকি 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র একটি ভিডিও-ও তুলে ধরে কংগ্রেস, যেখানে রাহুলকে 'অজেয়, আত্মবিশ্বাসী এবং অপ্রতিরোধ্য' বলে উল্লেখ করা হয়। তুলে ধরা হয় পদযাত্রার কিছু মন ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্তও।