কলকাতা: দেখতে দেখতে ৬ সপ্তাহ পার। রমরমিয়ে চলছে 'অপরাজিত' (Aparajito)। ছবির সাফল্যের সঙ্গে মানুষের আরও কাছের হয়ে উঠেছেন ছবির প্রত্যেক চরিত্র। আর এতকিছুর মাঝেই এবিপি লাইভের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা দেবাশিষ রায় (Debashis Roy)। ছবিতে তাঁকে সুবীর মিত্রের চরিত্রে দেখা গেছে। কেমন লাগছে এত প্রশংসা, কেমন করেই বা এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসা, সব প্রশ্নের খোলামেলা উত্তরে দেবাশিষ।


প্রশ্ন: অভিনয় জগতে আসা কীভাবে?
দেবাশিষ রায়: আমার অভিনয় শুরু থিয়েটার দিয়ে। শিব মুখোপাধ্যায় ও অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে 'নটধা'র হাত ধরে যাত্রা শুরু। তারপর দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার ও ব্রাত্য বসু। বর্তমানে নাটক করা হয়ে উঠছে না। তবে এখনও পর্যন্ত করা শেষ নাটকও ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায়, 'অথৈ জল'। আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময়েই মনস্থির করে ফেলেছিলাম যে অভিনয় ছাড়া কিছু করব না আর। বাবা তখন বলেছিলেন থিয়েটার হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রথম থেকেই তাই টেলিভিশন বা সিরিয়ালের দিকে না গিয়ে একেবারে থিয়েটারে ভর্তি হই। 


প্রশ্ন: সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারে তো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে গেলে অনেক সময়েই বাধা আসে। কারণ অনিশ্চয়তায় ভরা। কিন্তু আপনি অত ছোট বয়সেই অভিনয়কে বেছে নিয়েছিলেন। পরিবারের তরফে কেউ আপত্তি জানাননি?
দেবাশিষ: অবশ্যই। আসলে আমার বাবা একজন অসামান্য 'অসফল' অভিনেতা। এমন বলার কারণ, শুধুমাত্র পরিবারের চাপের জন্য অভিনয়কে তিনি পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। তিনি বহু বছর মঞ্চাভিনয় করেছেন। সেই থেকেই হয়তো অভিনয় আমারও মজ্জায়। তবে হ্যাঁ, আমি অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ায় বাবা সোজাসুজি আপত্তি না জানালেও ভয় পেয়েছিলেন। আমি তাঁকে দোষও দিই না। তবে বাবা আমাকে প্রথম দিন থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে এই পেশায় আসছ মানে এটা সম্পূর্ণ তোমার রিস্ক। কারণ এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। যা করতে হবে নিজেকেই করতে হবে। 


আর একটা কথা, যে কোনও জিনিসের জন্য তো চেষ্টা লাগে। সেই নিজে উদ্যোগ নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার শিক্ষাটা আমি মায়ের থেকে পেয়েছি। এছাড়া আমার শিক্ষক দেবাদিত্য মুখোপাধ্যায়েও আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেন। আমাকে ওয়ার্ল্ড সিনেমার সঙ্গে পরিচিতি এই মানুষটাই করিয়ে দেন। 


প্রশ্ন: পর্দায় প্রথম ব্রেক কবে?
দেবাশিষ: ২০১৮। ওই বছর আমার মাস্টার ডিগ্রি শেষ হয়। একটা ধারাবাহিক মুক্তি পায়। এবং ২০১৮ সালেই 'বাচ্চা শ্বশুর' ছবিটি মুক্তি পায়। পাভেল দা (পরিচালক পাভেল) এই ছবিতে ব্রেক দেন আমাকে।


প্রশ্ন: 'অপরাজিত' ছবির অফার আসে কীভাবে?
দেবাশিষ: সেটা সত্যিই বলার মতো গল্প। করোনার আগে আমি যে কটা ছবিতে কাজ করেছি সর্বত্রই খুব ছোট ছোট রোল ছিল। ২০২০ সালে লকডাউন শুরুর আগে শেষ মুক্তি পায় 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'। আমি ঘড়ি ধরে বলতে পারি সেখানে হয়তো ৩০ সেকেন্ড স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল আমার। কিন্তু আমি তো অল্পতে খুশি হই না। এরপর শুরু হল লকডাউন। বুঝলাম যে এরপর আমাদের মতো শিল্পীদের জন্য সময় খুব কঠিন হতে চলেছে। তাই সেই সময়টা খুব করে কাজে লাগাব বলে ঠিক করলাম। নিজের ট্যালেন্ট সেই সময় সকলের সামনে তুলে ধরব বলে সিদ্ধান্ত নিই। সেই সময়ে ঘরে বসে অভিনয় করে বেশ কিছু ভিডিও শ্যুট করে আপলোড করতে থাকি সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কৌশিক, আমার ভাই ও পরিচালক, আমাকে 'দ্য গ্রেট ডিক্টেটর'-এর ফাইনাল স্পিচটা পাঠায়। সেটা আমাকে রেকর্ড করতে বলে। সেই অত বড় মনোলগটা আমি ১১ দিন ধরে মুখস্থ করি, সেই ফিলিংটা নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করি। গোটাটা এরপর একটা টেকে রেকর্ড করে ফেসবুকে আপলোড করি। সেটা ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর অন্য একটি ভিডিও করে পোস্ট করি সেটা অনীক দার চোখে পড়ে। সেখান থেকেই অনীক দার সঙ্গে যোগাযোগ। সেই শুরু। এরপর একদিন দেখলাম অনীক দত্ত নিজেই অ্যাড দিয়েছেন যে 'অপরাজিত' ছবির জন্য অভিনেতা লাগবে, তখন আমি নিজেই ফোন করি ওঁকে। আমি নিজেই বলি সুবীর মিত্রের চরিত্রের অডিশন দিতে চাই। তারপর তো ওঁর সিদ্ধান্ত। এরপর সেই টেলিফোন কথোপকথনের সিনটাই আমি অডিশন করে পাঠাই। তারপর সিলেকশন।


আরও পড়ুন: Shoaib Kabeer Exclusive: কাসভ থেকে বংশী চন্দ্রগুপ্ত, একাধিক চরিত্রে নিজেকে তৈরির গল্প শোনালেন শোয়েব


প্রশ্ন: সুব্রত মিত্র বা পর্দার সুবীর মিত্রের সঙ্গে চারিত্রিক মিল পান?
দেবাশিষ: (হাসতে হাসতে) যখন আমাকে অনীক দা ফোন করে ফাইনালি জানান যে আমি সিলেক্টেড তখন ছবিতে আমার প্রথম সিনের মতনই অবস্থা হয়েছিল। ওটা খুব মিল পাই। কিন্তু সিনেমায় বলেছিলাম, 'ঠাট্টা করছ না তো?' আর বাস্তবে অনীক দার কথা শুনে 'ওয়াও' বলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেই জোরে ধমক খেয়েছিলাম। অনীক দা বলেছিলেন, 'তুমি খুবই ট্যালেন্টেড, কিন্তু এত উচ্ছ্বাস, এত এনার্জেটিক অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।' কারণ সুব্রত মিত্র খুব শান্ত, চুপচাপ একজন মানুষ ছিলেন। আমাকে বলা হয়েছিল আমার এই উত্তেজনা যেন ক্যামেরায় ১ শতাংশও ধরা না পড়ে।


প্রশ্ন: কীভাবে নিজেকে তৈরি করলেন?
দেবাশিষ: এই কৃতিত্ব সম্পূর্ণ অনীক দত্তের। তিনি আমাকে বেশ কিছু ভিডিও পাঠান। ডকুমেন্টারি পাঠান। আমি ছবিতে দেখবেন, চোখ পিটপিট করছি, চশমা খুলছি, সেগুলো সবই ওই ভিডিও থেকে নেওয়া। উচ্চারণ ঠিক করিয়েছেন, সঠিক করিয়েছেন অনীক দা। রাত্রিবেলা ভয়েস নোটে উচ্চারণ ঠিক করিয়েছেন অনীক দা। ফলে আমার কাছে 'অপরাজিত' একটা শিক্ষা। আমি তো নাম দিয়েছি, 'অনীক দত্তের পাঠশালা'। এখান থেকে আমি মাথা উঁচু করে বাঁচা আর নিজের মধ্যে সততা রেখে কাজটা মন দিয়ে করা, এই দুটো সবার আগে শিখেছি। ক্যামেরার সামনে সাবলীল থাকাও অনীক দা শিখিয়েছেন। 


এছাড়া সুপ্রতিম দা (সিনেম্যাটোগ্রাফার - সুপ্রতিম ভোল)। আমি ওঁকে বারবার বিরক্ত করেছি। কিন্তু তিনি আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছেন। 


প্রশ্ন: 'অপরাজিত' ছবির পর ছোটখাটো চরিত্রের অফার পেলে করবেন?
দেবাশিষ: ছোটখাটো চরিত্র সত্যি বলতে গেলে এখন করতে চাই না। মানে চরিত্রে গুরুত্ব বুঝে করব। ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলে আমি অবশ্যই রাজি। কিন্তু এর আগে যেমন গুরুত্বহীন বা যাকে বলে 'এক্সট্রাস', তেমন চরিত্র আমি একদমই করব না। আমার এখন চেষ্টা থাকবে আরও বেশি ভাল কাজ কীভাবে করা যেতে পারে সেই দিকে নজর দেওয়া।