কলকাতা : খুব ছোট বয়স থেকেই তিনি তারকা। একই অঙ্গে বহুগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় (Arindam Ganguly)। গায়ক, গীতিকার, সুরকার, লেখক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, ছবি পরিচালনা, সমস্ত কিছুতেই সমান পারদর্শী তিনি। ছোটবেলার পুজোটা কেটেছে উত্তর কলকাতার জগৎ মুখার্জি পার্কে। মাত্র ৭-৮ বছর বয়স পর্যন্ত ওখানে থাকলেও, ওখানকার পুজোই তাঁর চোখে লেগে রয়েছে এখনও। পরবর্তীকালে দক্ষিণ কলকাতায় বসবাস করলেও অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ছেলেবেলার পুজো বলতে জগৎ মুখার্জির পার্কের পুজো।
এবিপি লাইভের সঙ্গে ছোটবেলার পুজোর দিনগুলোর কথা বলতে বলতে স্মৃতিতে বিভোর হয়ে গেলেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। সদাহাস্য গায়ক, অভিনেতা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় কথা বলতে বলতে যেন টাইম মেশিনে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন বহু বছর আগের উত্তর কলকাতার জগৎ মুখার্জি পার্কের পুজোয়। তাঁর স্মৃতিচারণা এতটাই মনমুগ্ধকর যে, শুনতে শুনতে আজ থেকে বহু বছর আগের উত্তর কলকাতার সেই বিখ্যাত জগৎ মুখার্জি পার্কের পুজোর দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, 'এখন আমরা চারপাশে পুজোয় নানা থিম দেখতে পাই। কিন্তু আমার ছেলেবেলার সময়ই ওখানে থিমের পুজো হত। ওখানে প্রতিমা গড়তেন অশোক বসু নামে এক মৃৎশিল্পী। তিনি আবার সাধারণ কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী নন। প্রতিমা গড়ার উপর ডিগ্রীধারী ছিলেন। উনি নিজেই ঠাকুর বানাতেন। জগৎ মুখার্জি পার্ক থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই একটা রাজবাড়ি মতো রয়েছে, ওখানেই তখন ঠাকুর বানাতেন। প্রতিমা তৈরি দেখার উপর আমার অমোঘ আকর্ষণ ছিল। যেখানে ঠাকুর তৈরি হত, সেখানে গিয়ে আমি উঁকিঝুঁকি মারতাম। অদ্ভূত আকর্ষণ অনুভব করতাম। তখন ঠাকুরও তৈরি হত অন্যভাবে। আমরা সেটাকে আর্টের ঠাকুর বলতাম। ঠাকুর তৈরির সময় কাঠের একটা ফ্রেম তৈরি করতেন। সলিড কাঠের ফ্রেম। সেই কাঠের উপরে মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়তেন। প্রতিবছর আলাদা আলাদা থিমের উপর পুজো হত জগৎ মুখার্জি পার্কে। পারিপার্শ্বিক সমাজের পরিস্থিতি অনুযায়ী থিম উঠে এসেছিল মৃৎশিল্পী অশোক বসুর হাত ধরে। আমার পুজো ওখান থেকেই। দুর্গাপুজোর উপর আমার যে আকর্ষণ, তা গোটাটাই ওখান থেকে। পুজোর দিনগুলোয় প্যান্ডেলের পাশ থেকে আলুকাবলি খেতাম। সেই আলুকাবলির স্বাদ এখনও ভুলিনি। আমাদের সময় পুজো মানেই ছিল বাইরে বেরিয়ে একটু খাওয়া দাওয়া।' জানাচ্ছিলেন, এখনকার পুজোর ধরন আর তখনকার পুজোর ধরনের মধ্যে কতটা মিল কিংবা অমিল কিংবা এখন যেটাকে আমরা নতুন বলে মনে করছি, সেটা বহু বছর আগে এই বাংলার বুকেই কোথাও হয়ে গিয়েছে, তার একটা চর্চা থাকা দরকার।
আরও পড়ুন - Durga Puja 2021 Exclusive: চণ্ডী সেলাই থেকে জুতো পাঠ করেছি উঠতি বয়সের দুর্গাপুজোয় : সব্যসাচী চক্রবর্তী
খুব ছোট বয়স থেকেই গান লেখা এবং গান গাইতেন তিনি। পুজোর দিনগুলোয় স্টেজের কাছে অপেক্ষা করতেন, কখন তাঁকে স্টেজে ঘোষণা করতে দেওয়া হবে। বলছিলেন, 'জগৎ মুখার্জি পার্কে ঢুকলে দেখবেন একটা চাতাল মতো তৈরি করা রয়েছে। ওই চাতালে মাইক রাখা থাকত। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন আমাকে একটু বলতে সুযোগ দেওয়া হবে।' গল্প করতে করতে সত্যিই যেন সেই দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছিলেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। একেবারেই সেই ছোটবেলার দিনগুলোর সুরে ঘোণষা করে উঠলেন, 'এবার পুষ্পাঞ্জলি শুরু হচ্ছে। আপনারা সকলে চলে আসুন।' বললেন,'' হাতে যখন মাইকটা পেয়ে যেতাম, তখন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে দু-চার কলি গানও গেয়ে দিতাম।''
প্রস্তর সাক্ষর ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করা শুরু করেছিলেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর অভিনয় করেন কখনও মেঘ ছবিতে। একদিকে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করছেন। অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দুজনেরই স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। স্মৃতিচারণা করে বললেন, 'উত্তম কুমার এতটাই ভালোবাসতেন যে লক্ষ্মীপুজোর দিন আমার উত্তর কলকাতার বাড়ি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। লক্ষ্মীপুজোর সময় ওঁর বাড়ি যেতাম।'
দক্ষিণ কলকাতাতে জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটালেও উত্তর কলকাতা আজও অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে বড়ই নস্টালজিয়ার। ছোটবেলার দিনগুলোর কথা বলতে বলতেই বারবার যেন উত্তর কলকাতার বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছিলেন পর্দার 'হংসরাজ'। বলছিলেন, 'আমার কাছে দুর্গাপুজো মানেই উত্তর কলকাতার পুজো। আমি ছোটবেলায় যে পুজোগুলো দেখেছি, তাতে একটা রুচির ছাপ থাকত। সেই সময় যখন পুরোদমে গানও গাইছি, তাই পুজোর জলসাগুলোতেও গান গাইতাম। বাংলার তাবড় তাবড় শিল্পীরা জলসায় আসতেন। তাঁদের সঙ্গে সেই জলসার অন্যতম শরিক আমিও ছিলাম। আজ ভাবতে ভালো লাগে, যেহেতু খুব ছোট থেকেই গান গাইছি, তাই বড় বড় শিল্পীদের সঙ্গে আমার আকর্ষণও অন্যরকম ছিল। আমার আর রুমকি ঝুমকি মানে আপনাদের দেবশ্রীর আকর্ষণ অন্যরকম ছিল। ওদের নাচ আর আমার গানের সাংঘাতিক আকর্ষণ ছিল। তখন কাগজে বিজ্ঞাপন বেরতো যে, বিশাল বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। সেখানে অন্যান্য বড় বড় শিল্পীদের নামের সঙ্গে একেবারে শেষে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মাস্টার অরিন্দম ও রুমকি ঝুমকি লেখা থাকত। তখনকাল জলসায় যে রুচিশীল অনুষ্ঠানগুলো হত, তা অন্যরকম ছিল। আজ ভাবতে গেলে হয়তো অবাক লাগবে, তখন অনুষ্ঠানের একেবারে শেষের দিকে একটা কি দুটো হিন্দি গান থাকত। বাকি পুরোটাই বাংলা গান বা বাংলা ভাষার উপর হত। পরবর্তীকালে পরিবেশটাই খারাপ হয়ে গেল। পুরস্কার কীভাবে পাওয়া যায়, সেদিকে নজর দিতে গিয়ে রুচিতে ঘাটতি পড়ল।'
আরও পড়ুন - Durga Puja 2021 Exclusive: মায়ের পুজোয় আবার সাধারণ কিংবা ভিআইপিদের আলাদা আলাদা গেট হয় নাকি : তরুণ মজুমদার
থিমের রুচিশীলতাকেই এখনও মনে রেখে দিয়েছেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। খুব ছোটবয়স থেকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করলেও তাঁর কেরিয়ারে অন্যতম হয়ে রয়েছে হংসরাজ। তারপর কতটা বদলে গেল তাঁর ছেলেবেলার পুজো? বললেন, 'হংসরাজ করে ফেলার পর আর বাইরে ঘুরে বেড়ানোটা হত না।' শতাব্দী রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই । ঠাকুর দেখতে যাওয়া প্রসঙ্গে বললেন,'আমাদের একটা দল ছিল। আমি, শতাব্দী, আমার বোন আরও কয়েকজন মিলে রাতে ঠাকুর দেখতে যেতাম গাড়ি করে। অনেক রাতে ঠাকুর দেখতে গিয়ে সারারাত ধরে পুরো কলকাতা ঠাকুর দেখতাম। তখন শতাব্দী বড় অভিনেত্রী হয়ে গিয়েছে। সেই সময়টা খুব উপভোগ করেছি।'
'মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রথম গানের অ্যালবাম বেরোয়। তবে তার আগে এইচএমভি থেকে ঠাকুমার ঝুলি নামে অ্যালবাম বেরোয়। একদিকে ছিল বুদ্ধুভুতুম অন্যদিকে ছিল নীলকমল লালকমল। সেই নীলকমল লালকমলে, নীলকমল আমি করেছিলাম নচিকেতা ঘোষের সুরে। ঠাকুমার ঝুলির সেই রেকর্ড ইতিহাস তৈরি করেছিল। পরবর্তীকালে আমার ছেলেকে ঠাকুমার ঝুলির রেকর্ড চালিয়ে খাওয়াতে হল। পরবর্তীতে ও নীলকমল লালকমল শুনে শুনে ভয় পেতো আর খেয়ে নিতো।' বলছিলেন, অনেকেই জানেন না লালকমল নীলকমলের একটা গান, 'ওই লালকমলের আগে নীলকমল জাগে।' গানটি তাঁর গাওয়া। পরবর্তীতে প্রায় সমস্ত পুজোতেই গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে। এবারেও বেরবেন পুজো দেখতে। শহরের সবকটা পুজো দেখতে গিয়ে যখন ঢুকে পড়বেন জগৎ মুখার্জি পার্কে, আজকের অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় সবার অলক্ষেই ছোট্ট 'হংসরাজ'-র মতো হয়তো মাইক হাতে গেয়ে উঠবেন, 'শহরতারের গোলকধাঁধায় আঁধার হল মন... মন্দ ভালোর এই কি খেলা চলছে হেথা সর্বক্ষণ... আঁধার হল মন...।'