পুরুষোত্তম পণ্ডিত, কলকাতা: ডাকাতিও হতে পারে বৈপ্লবিক। দালির মুখোশে মুখ ঢাকা ডাকাতদলের সদস্যরা মুখোশ খুলে মিউজিয়মের বাইরে এসে অগুন্তি বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ায়, সংশয় মুছে। লাল জাম্পস্যুট আর হাতে ধরা একটা সাদা পতাকা প্রতীকী হয়ে ওঠে। জনতা তাঁদের সমর্থনে গলা তোলে। প্রফেসরের টিমের সদস্যদের শর্ত মেনে শুরু হয় নতুন এক খেলা। এ খেলা শুধুই বন্দুকের গুলি আর গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে লেখা মৃত্যুর খেলা নয়। 'মানি হাইস্ট সিজন ফাইভ ভলিউম ওয়ান' প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছে, এ বার কোনও অঙ্কই আর পিছু ফেরার নয়। প্ল্যান এ না মিললে প্ল্যান বি-এর আকস্মিক অবতারণাও নয়। অ্যালিসিয়া সিয়েরা গর্ভযন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপেই বলে ফেলে সেই অমোঘ সত্য। এবারের প্ল্যান ‘দ্য বার্থ প্ল্যান’। প্রফেসর আর তার দুই সঙ্গীকে নিজের কব্জায় এনেও সন্তানের জীবন সঙ্কট কাটাতেই তাঁদের মুক্তি দেয় অ্যালিসিয়া। একজন মা, নিজের কতর্ব্য আর সন্তানের জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে দু'কূল রক্ষা করতে কতটা যন্ত্রণা সইতে পারেন, কত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তা দেখিয়ে দিয়েছে অ্যালিসিয়া। প্রফেসরের হাতে শুধু অ্যালিসিয়ার সন্তানের জন্ম হয় না, জন্ম হয় এক সম্ভাবনার। পায়ের পাতায় বিঁধে থাকা অ্যালিসিয়ার বন্দুকের গুলি বার করতে করতে প্রফেসরের চোখ যেন একটাই কথা বলে, সম্ভাবনার কোনও মৃত্যু নেই। কাহিনির আপাত উত্তেজনার ঊর্ধ্বে উঠে দশর্কের মাথায় যে ভাবনা, যে দৃষ্টিভঙ্গি বুনে দেন অ্যালেক্স পিনা, তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
'মানি হাইস্টে'র অন্তিম পর্বের প্রথম ভাগ জুড়ে ফ্ল্যাশব্যাকের অবতারণা। ফিরে ফিরে আসে বার্লিন। আর বার্লিনই হাইস্টের এক নতুন সংজ্ঞা দেয় তাঁর ছেলের কাছে। স্বপ্ন দেখায় এক অকৃত্রিম মুক্তির। দ্য আলটিমেট ফ্রিডম। ভয়ের মুখোমুখি না হলে ভয়কে জয় করা যায় না। বার্লিনের হাত ধরেই তাঁর ছেলে রাফেল নিজের দ্বিধা আর ভয়কে অতিক্রম করে। হাইস্ট প্ল্যানের ভবিষ্যৎ আগে থেকেই কি নির্ধারণ করতে পারত বার্লিন? তাই সে এতটা আত্মবিশ্বাসী? মানি হাইস্টের একের পর এক অধ্যায় পেরিয়ে এসে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়, প্রফেসর আর বার্লিন, দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রফেসরের মনে সংশয়ের ছায়া থাকলেও বার্লিনের মনে কোনও সংশয় ছিল না। আর বার্লিনের সেই সংশয়হীন আত্মবিশ্বাসই যেন পরোক্ষে প্রফেসরকে লড়াইয়ের ইন্ধন জুগিয়ে গিয়েছে। হারতে শেখায়নি। তবে কিছু জিততে হলে তার মূল্যও দিতে হয়। বার্লিন এই কথাও বলে। বিপ্লবে সাফল্য এমনি এমনি আসেনা, তার জন্য কঠিন মূল্য চোকাতে হয়।
বন্দুকের গুলির শব্দ, রক্তের দাগ ছাপিয়ে মানি হাইস্টের পঞ্চম সিজন প্রেমের কাহিনিও শোনায়। প্রথম প্রেম। সেই প্রেম কোনও শরীরের অস্ত্বিত্বের পরোয়া করে না, সেই প্রেম ঝাপসা হয় না সময়ের ধুলোর চাদরে। টোকিও লিসবনের কাছে নিজের ভালবাসার কাহিনি শোনায়। পুলিশের বন্দুকের গুলিতে প্রথম প্রেমিকের মৃত্যুর কাহিনি শোনায়। পঞ্চম সিজনের ভলিউম ওয়ানে টোকিও ভালবাসার, পেশাদারিত্বের, সাহসের আর আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
হাইস্ট ফিল্মের দীর্ঘ তালিকায় ‘দ্য আর্ট অফ দ্য স্টেল’, ‘কিং অফ থিভস’, ‘ফ্ললেস’, দ্য ইটালিয়ান জব, রনিন, থেকে ওশন’স সিরিজ - প্রচুর ছবি রয়েছে। কিন্তু
প্রবল প্রতিরোধ পেরিয়ে গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় না লাগিয়ে ডাকাতি সেরে পিঠটান দেওয়ার মত কল্পকথার পথে হাঁটেননি মানি হাইস্টের স্রষ্টা অ্যালেক্স পিনা। শুধু রোমহর্ষক উত্তেজনায় অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ নয়, এই সিরিজের কাহিনি জুড়ে প্রফেসর আর বার্লিনের জীবনদর্শনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন একের পর এক ঘটনার সম্মুখীন হবেই। কিন্তু সেই সব ঘটনার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়াই কি বেঁচে থাকার সার্থকতা? না, তা নয়। স্রোতে ভাসার গড়পড়তা জীবনবোধ বদলে দিতে চান প্রফেসর আর বার্লিন। 'মানি হাইস্ট' সেই বদলের দাবি রাখে।
প্রফেসরের হাইস্ট টিমের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ছবি দেখতে দেখতে সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা ‘ডাকাতের মা’ গল্পটা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। ডাকাতি করে সাজা পেয়ে জেল খাটার পর ছেলে যখন বাড়িতে ফেরে, তখন কপর্দকশূন্য মা ছেলের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য অন্যের বাড়ির ঘটি চুরি করে বিক্রি করে। সেই টাকায় আলু-চচ্চড়ি আর ভাত রাঁধে। নিয়তির পরিহাসে বাড়িতে পুলিশ আসে। মাকে বাঁচাতে ছেলে বলে চুরিটা সেই করেছে। চুরি করা ঘটি বিক্রি করে মায়ের হাতে এসেছিল চোদ্দ পয়সা। হাতকড়া পরে ছেলে পুলিশের সঙ্গে ঘর ছাড়ার আগে মায়ের হাতে দিয়ে যায় তার সঞ্চিত নগদ ৯০ টাকা। কাহিনির মিল নয়, মিল এখানে অনুভূতির। টোকিও, ডেনভার, হেলসিঙ্কি, রিওরা প্রফেসরের প্রতি আনুগত্য আর নিখাদ ভালবাসায় যে অনুভূতির জন্ম দেয়, তা তুলনাহীন।
'মানি হাইস্টে'র প্রতিটি চরিত্রই যেন জীবন্ত। যাঁর যতটুকু অভিব্যক্তি দরকার, ঠিক ততটুকুই রয়েছে সিরিজটির প্রতিটি পর্বে। অভিনয়ের ধার একটুও ভোঁতা হয়নি কারও ক্ষেত্রে। আলভেরো মোর্তে, উরসুলা কোরবেরো, পেদ্রো অ্যালেনসো, এনরিক আর্সি...সব্বাই নিজের সেরাটুকু নিংড়ে দিয়েছেন এই ওয়েব সিরিজে। কাহিনিতে প্রফেসরের সঙ্গে তাঁর টিমের যে সম্পর্ক, ক্যামেরার নেপথ্যে অ্যালেক্স পিনার সঙ্গেও টিম 'মানি হাইস্টে'র প্রত্যেক সদস্যের সম্পর্ক যে তেমনই বিশ্বাস আর চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ, তা বোঝাই যায়। চিত্রনাট্যে ধারাবাহিক মাদকতা বজায় রেখেই 'মানি হাইস্ট সিজন ফাইভ এখন ভলিউম টু'য়ের অপেক্ষায়।
আরও পড়ুন: Mimi movie review: সারোগেসির প্রেক্ষাপটে মাতৃত্বের গল্প ‘মিমি’
আরও পড়ুন: Shershaah Movie Review: ফিল্মি ছোঁয়া থাকলেও 'শেরশাহ'-তে নজর কাড়বে সিদ্ধার্থ-কিয়ারার অভিনয়