কলকাতা:--'হঠাৎ করে বিতর্কটা এভাবে থামিয়ে দিলেন কেন? আপনাকে এই নিয়ে আরও কয়েক গুচ্ছ চিঠি লিখতে পারতাম।'
---'আপনার মতো ভক্ত আমার নেই, মানুষের জোরও নেই। আমি একেবারে একা। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার সব ক'টি চিঠিরই উত্তর দিতাম।'
দু'জন বক্তাই কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) ও মৃণাল সেন (Mrinal Sen)। এই আলাপচারিতার কয়েক মাস আগেই মুক্তি পেয়েছে মৃণাল সেনের 'আকাশ কুসুম' (Akash Kusum)। তার পর থেকে 'দ্য স্টেটসম্যান' পত্রিকায় পত্রযুদ্ধ চলছে দুই পরিচালকের। অবশেষে,পত্রিকার তরফে, ১৯৬৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিতর্কে ইতি টানার কথা ঘোষণা করা হয়। ঘটনাচক্রে সেই দিনই ফিল্ম সোসাইটিতে একটি ছবির স্ক্রিনিং উপলক্ষ্যে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল দুই পরিচালকের। হালকা মেজাজ কিন্তু জলদগম্ভীর স্বরে রায়সাহেব জিজ্ঞাসা তখন করেন, 'হঠাৎ করে বিতর্কটা এভাবে থামিয়ে দিলেন কেন? আপনাকে এই নিয়ে আরও গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠি লিখতে পারতাম।'
তৈরি ছিলেন 'আকাশ কুসুম' ছবির পরিচালকও। বলে দেন,'আপনার মতো ভক্ত আমার নেই, মানুষের জোরও নেই। আমি একেবারে একা। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার সব ক'টি চিঠিরই উত্তর দিতাম।'
যাঁরা দুজনকেই কাছ থেকে দেখেছেন,তাঁদের মতে এর পরের অন্তত তিনটে দশক একে অন্যের থেকে এভাবেই সম্মানজনক দূরত্ব রেখে গিয়েছেন বাংলা তথা ভারতের দুই প্রবাদপ্রতিম পরিচালক। হালকা রসিকতার আড়ালে একে অন্যের কাজের ব্যাপারে প্রকাশ্য়ে মন্তব্য এড়িয়ে যাওয়াই পছন্দ করতেন,এমনই শোনা যায়। তবে ব্যতিক্রম যে হয়নি, তা নয়। ঠিক কী ভাবে ব্যাখ্য়া করা যায় দু'জনের এমন সম্পর্ক? কিছুটা প্রহেলিকা।
অথচ বিতর্কের শুরুটা এমন ছিল না। অন্তত তেমনই শোনা যায় স্বয়ং 'আকাশ কুসুম' ছবির পরিচালকের স্মৃতিচারণায়। রায়সাহেব তাঁকে ফোন করে জানিয়েছিলেন,'আকাশ কুসুম'নিয়ে যে পত্রবিতর্ক শুরু হয়েছে, এবার তিনিও তাতে সামিল হচ্ছেন। মৃণাল সেন যেন কিছু মনে না করেন। তবে সম্ভবত সত্যজিৎ রায় একথাও জানিয়েছিলেন,যে তাঁর সমালোচনার মূল লক্ষ্য কাহিনিকার তথা চিত্রনাট্যকার আশিস বর্মন। যদিও বাস্তবে দেখা যায়, ছবিটির সমসাময়িকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন অস্কারজয়ী পরিচালক। স্থির থাকতে পারেননি মৃণাল সেন। অতএব চিঠি...পাল্টা চিঠি। পাঠকদের মধ্যেও দুটি স্পষ্ট মত তৈরি হয়ে যায়।
স্বপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে চার্লি চ্যাপলিনের কথা এনেছিলেন মৃণাল সেন। তাতে পত্রযুদ্ধ আরও তীব্র হয়। ব্যঙ্গবিদ্রুপের পর এবার একেবারে শাণিত সমালোচনা বেরোল রায়সাহেবের কলম থেকে। লিখলেন, “A crow film, is a crow film is a crow film." মন্তব্য়টি কার্যত কিংবদন্তী হয়ে থেকে গিয়েছে। তবে পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যায় যে পত্রিকার তরফে ঘোষণা করতে হয়েছিল এই বিতর্ক নিয়ে আর কোনও চিঠি প্রকাশিত হবে না। সেই সঙ্গে দুই পরিচালকের পত্রযুদ্ধে ইতি পড়ে বটে, কিন্তু যা আজও সাধারণ দর্শকের কাছে রহস্য,তা হল কেন “আকাশ কুসুম" ছবির থিম এতটা অপছন্দ হয়েছিল রায়সাহেবের? কেনই বা পরবর্তীকালে নিজের ছবির ভাষা এত বদলে ফেলেছিলেন মৃণাল সেন? ফিল্ম সমালোচকদের অনেকের মতে,দুজনে যেন নিজেদের ছবির ভাষা বেশ কিছুটা পাল্টাপাল্টি করে নিতে চেয়েছিলেন। তবে ফারাকও ছিল বিস্তর।
বন্ধু...
পত্রযুদ্ধের পর থেকে দুই পরিচালকের সম্পর্ক কোন খাতে বয়েছিল,তা নিয়ে আর এক প্রস্ত বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু অনেকেই যা জানেন না, তা হল এক সময় “পথের পাঁচালি"-পরিচালকের সঙ্গে রীতিমতো সখ্য ছিল মৃণাল সেনের। চার্লি চ্যাপলিনের উপর তাঁর লেখা বইয়ের অলংকরণ করে দিয়েছিলেন মানিকবাবু। আবার তাঁর লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে ফিল্ম নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন মৃণাল সেনও। “অপরাজিত" দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন "ভুবন সোম"-র পরিচালক। ঠিক যেমন ভাবে "ওকা উরি কথা" দেখে দরাজ প্রশংসা করেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু পত্রযুদ্ধের অভিঘাত কোথাও কি একটা দূরত্ব রেখে গিয়েছিল? যাঁরা উত্তর দিতে পারতেন, সেই দু'জনের কেউই আজ নেই। রয়ে গিয়েছে কিছু তথ্য, কিছু জল্পনা ও ধোঁয়াশা।
আর যা...
তবে শুধু যে আকাশ কুসুম নিয়েই দুজনের মধ্যে "মনোমালিন্য" হয়েছিল,তা নয়। শোনা যায়,ঘনিষ্ঠ এক ফিল্ম ক্রিটিককে এক ব্যক্তিগত চিঠিতে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, "তথাকথিত আর্ট ফিল্ম বানাতে যে সব পরিচালকদের উৎসাহ রয়েছে তাঁরা আসলে বিদেশের ফেস্টিভ্যালগুলিতে যেতে বেশি ইচ্ছুক। দেশের দর্শকদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরির দিকে নজর নেই তাঁদের। মৃণাল-সহ এঁদের কেউই গল্প বলতে জানেন না।' যদিও চিঠিটি একেবারে ব্যক্তিগত পত্র ছিল। অস্কারজয়ী পরিচালক মোটে চাননি, এটি প্রকাশ্যে আসুক। অথচ সেটিই হয়। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর অনুমতি ছাড়াই ব্যক্তিগত চিঠিটি প্রকাশিত হয় একটি জাতীয় দৈনিকে। ততদিনে ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন "দ্য অপু-ট্রিলজি"-র পরিচালক। সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে আর তর্ক করতে চাননি মৃণাল সেন।
অবশ্য এর পর আর তর্কের অবকাশও হয়নি। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল চলে যান অস্কারজয়ী পরিচালক। তাঁর প্রয়াণের খবর শুনে সটান নার্সিং হোমে পৌঁছে গিয়েছিলেন মৃণাল। ঘনিষ্ঠমহলে জানা যায়, সত্যজিৎ রায়ের শেষকাজের সময় কেমন যেন আনমনা দেখিয়েছিল "ওকা উরি কথা"-র পরিচালককে। কেন? বন্ধুত্ব, পত্রযুদ্ধ, সমালোচনা, সম্মানজনক দূরত্ব-- সে দিন কি এসব কিছুরই "ফ্রিজ ফ্রেম" দেখেছিলেন মৃণাল? জানা নেই। তবে যা জানা, সেও কম আশ্চর্যের নয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের "মানিক" জন্মেছিলেন যে মাসে, সেই মে-তেই জন্মেছিলেন মৃণাল। স্রেফ সমাপতন?
হয়তো তাই, বা নয়। কিন্তু মতান্তর-মনান্তর সত্ত্বেও যে একে অন্যকে সম্মান করা যায়, তর্ক যে আসলে মানুষকে সমৃদ্ধ করে, সে সবই হাতেকলমে বাঙালিকে দেখিয়ে গিয়েছেন ওঁরা। বাকিটা ওঁদের ব্যক্তিগত পরিসর। সেই বোঝাপড়াটা না হয় অন্য কোনও অনন্তে সেরে নিন দুই কিংবদন্তী।
(তথ্যসূত্র:Mrinal Sen Sixty Years in Search of Cinema By Dipankar Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন:গরমে ব্রন নিয়ে জেরবার ? এই নিয়মগুলি মেনে চললে মিলবে মুক্তি