কলকাতা: একজন মেকআপ আর্টিস্টের জীবন যে চিত্রনাট্যের বিষয়বস্তু হতে পারে, সেটা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'ভিঞ্চিদা' না দেখলে বোধহয় কেউ ভাবতেই পারতেন না। রুপোলি পর্দায় এক প্রস্থেটিক মেকআপ (Prosthetic Makeup) আর্টিস্টের জীবনযুদ্ধ, কাজ না পেতে পেতে কোনঠাসা হয়ে পড়া এবং নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাওয়া অন্ধকার জগতের সঙ্গে..দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল এই গল্প। এ তো চিত্রনাট্য। কিন্তু টলিউডের অন্দরে উঁকি মারলেই খোঁজ পাওয়া যাবে এমন এক শিল্পীর, যিনি বাস্তবে 'ভিঞ্চিদা'-র মতোই নিখুঁত প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট। টলিউডের যাবতীয় পরিবর্তনের রূপটান দিয়ে থাকেন তিনিই। সোমনাথ কুণ্ডু (Somnath Kundu)। বর্তমানে প্রস্থেটিক মেকআপের প্রয়োজনে টলিউডের সবচেয়ে ভরসার জায়গা ইনিই। 


'গুমনামী'-র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (Prosenjit Chatterjee) থেকে শুরু করে শুরু করে 'স্বস্তিক সংকেত'-এর শ্বাশত চট্টোপাধ্যায় (Saswata Chatterjee), 'মহানন্দা'-র গার্গী রায়চৌধুরী (Gargi Roychowdhury) কিম্বা জিতু কমলকে (Jitu Kamal) সত্য়জিৎ করে তোলা, পরিচালক , অভিনেতা, অভিনেত্রীরা সোমনাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একসময় যে শিল্পীকে প্রস্থেটিকের কাজে হাত দিতে বারণ করা হয়েছিল, এখন প্রস্থেটিকের জগতে তাঁকে চোখে হারায় টলিউড। এখনও পর্যন্ত কার রূপ পরিবর্তন সবচেয়ে কঠিন ছিল? সোমনাথ বলছেন,  'প্রত্যেকটা কাজই এক একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন বলতে আমি 'গুমনামী'-তে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মেকআপ করার কথাই বলব। মোট ৫টা লুক নিয়ে কাজ হয়েছিল। আমি বুম্বাদার বাড়ি গিয়ে ওনার মেকআপ করেছিলাম প্রথম লুক সেটের সময়। ৩ বার লুক সেট হয়েছিল। শেষবার সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। নেতাজির ছবি বোধহয় আমাদের সকলের বাড়িতেই রয়েছে। তাই যদি প্রস্থেটিকে গোলমাল হয়, দর্শক ক্ষমা করবেন না। এই ভয়টা সবসময় কাজ করেছে মাথার মধ্যে। আমি শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কেও নেতাজি সাজিয়েছি। তবে ওনার মুখে নেতাজির আদল দেওয়া তুলনায় সহজ ছিল। বুম্বাদা সুদর্শন নায়ক। তাঁকে নেতাজির মত করে তোলা কঠিন ছিল।'


আরও পড়ুন: 'ছেলে দেখেছে, বাবা কাজ জেনেও মাসের পর মাস বাড়িতে বসে থাকে'


সম্প্রতি 'মহানন্দা' ছবিতে গার্গী রায়চৌধুরীকে মহাশ্বেতা দেবীর আদলে সাজিয়ে তুলেছেন তিনি। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সোমনাথ বলছেন, 'আমায় বলা হয়েছিল, অবিকল মহাশ্বেতা দেবীর মতো করে সাজাতে হবে না। তাই করেছিলাম। গার্গী রায়চৌধুরীর বয়সকালকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। তবে চুলের কায়দা ও মুখের আদল মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছি। বাকিটা দর্শকেরা বলবেন কেমন লেগেছে।'


টলিউডে লম্বা কেরিয়ার। এমন কোনও ঘটনা ঘটেছে যা গোটা জীবন অনুপ্রেরণা দেবে? সোমনাথ বললেন, 'এমন স্মৃতি আছে। অনেকদিন আগের কথা। সেসময় আমি সদ্য কাজ শিখছি। আমার গুরু সুব্রত সিংহর সঙ্গে কাজ করি। 'কুলাঙ্গার' বলে একটি ছবির জন্য কলকাতায় শ্যুটিং করতে এসেছিলেন মালা সিনহা। আমার গুরু ওনার মেকআপ করতেন আর জুনিয়ররা বাকিদের। একদিন আমি শকুন্তলা বড়ুয়ার চুল বেঁধে দিয়েছিলাম। মালা সিনহার সেটা খুব পছন্দ হয়। জিজ্ঞাসা করেন, কে করেছে। শকুন্তলাজী আমায় দেখিয়ে দেন। মালা সিনহা আমার কাছে এসে বলেন, 'আগামীকাল আমার মেকআপটা তুমি করবে।' পরেরদিন সকালে সত্যি সত্যিই সময়ের আগে স্টুডিওতে এসে হাজির হন মালা সিনহা। চেয়ারে বসে আমায় বলেন মেকআপ করতে। আমি দোটানায় পড়ি। গুরুকে না জানিয়ে মেকআপ করব কী করব না ভাবছি। শেষে আর করাই হল না মেকআপটা। উনি চলে গেলেন। এখনও মনে হয়, সেদিন সুযোগটা নিলেই ভালো হত।'


কেবল মালা সিনহা নয়, প্রেম চোপড়ার সঙ্গেও স্মৃতি রয়েছে সোমনাথের। বলছেন, 'আরেকবার অন্য একটা শ্যুটিংয়ের জন্য প্রেম চোপড়া এসেছিলেন কলকাতায়। ওনার প্রথমদিনের মেকআপ করেছিলাম আমি। যখন মেকআপ শেষ করে ঘর থেকে বেরোলাম, দেখলাম, গোটা ইউনিট বাইরে দাঁড়িয়ে। প্রেমজী বেরিয়ে এসে বললেন, 'খুব কম সময়ে দারুণ মেকআপ করেছে ও। মুম্বইতে কাজ পাওয়া উচিত।'


এ তো গেল ভালো অভিজ্ঞতার কথা। আর খারাপ? মৃদু হেসে সোমনাথ বললেন, 'সেও অনেক আছে। তখন সদ্য সদ্য় কাজ শিখছি। টাকাপয়সা পাই না, টিফিন নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যেতাম। একজন শিল্পী একবার ওডিকোলন চেয়েছিলেন। দিতে দেরি হয়েছিল বলে প্রচণ্ড অপমান করেছিলেন। আর সম্প্রতি আরেকজন শিল্পী, নাম বলতে চাই না, তাঁর মেকআপ করছি। গোটা মেকআপের সময় তিনি ফোনে ব্যস্ত রইলেন। এভাবে প্রস্থেটিক মেকআপ করতে সমস্যা হয়। মুখে সঠিকভাবে বসে না। শিল্পীকে বার বার বারণ করলাম উনি ফোন রাখলেন না। শেষে একটু রাগারাগিই হল। সবকিছুই তো মনঃসংযোগের ব্যাপার। ওই ছবিটার মুক্তি নিয়ে আমি চিন্তায় আছি। ওই ঘটনার প্রভাব কাজে পড়বে না তো!'