কলকাতা: ঘড়িতে তখন সন্ধে ৬টা বেজে গিয়েছে। মঞ্চে কলাকুশলীদের অভিনয় শুরু করে দেওয়ার কথা। টিকিটেও উল্লেখ করা রয়েছে যে, 'তিতুমীর' শুরু ঠিক ছ'টায়।
অথচ আকাদেমির গেট বন্ধ করার উপায় নেই। হাউজ়ফুল শোয়ে দর্শকদের নির্দিষ্ট আসনে বসাতে যেন কালঘাম ছুটছে মঞ্চের কর্মীদের। আর ঠিক সেই সময়ই 'বাঁশের কেল্লা'র সামনে দাঁড়িয়ে একজন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, 'উৎপল দত্তের লেখা এই নাটক বহু পুরনো হলেও, এখনও প্রাসঙ্গিক।' পরে নাটকের পরতে পরতে এমন কিছু দৃশ্য ও সংলাপ দেখা ও শোনা গেল যে, দর্শকেরাও শোয়ের শেষে বলাবলি করছিলেন, সত্যিই এই নাটক যেন অতীতের আয়নায় এক টুকরো ভবিষ্যৎ।
আর সেই কারণেই কি রাজধানীতে ব্রাত্য হয়ে পড়ল জয়রাজ ভট্টাচার্য নির্দেশিত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য (Anirban Bhattacharyya) অভিনীত নাটক 'তিতুমীর'? ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যে নাটক দেখে যেন ঘোরের মধ্যে হলঘর ছাড়লেন দর্শকেরা, অভিনয় থেকে শুরু করে সংলাপ, নন্দন চত্বরে কড়া শীতেও অনেক রাত পর্যন্ত যা নিয়ে মুগ্ধ দর্শকেরা চর্চা করলেন, সেই নাটক দিল্লিতে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ার পিছনে নাহলে আর কী-ই বা কারণ থাকতে পারে, ভেবে পাচ্ছেন না নির্দেশক-উপস্থাপকেরাও।
নয়াদিল্লিতে ভারত রঙ্গ মহোৎসবে ২২ জানুয়ারি মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল 'তিতুমীর'। প্রতিযোগী নয়, এবারের উৎসবের বিষয়বস্তুকে মাথায় রেখেই আমন্ত্রণ পেয়েছিল 'তিতুমীর'। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপনে ভারত রঙ্গ মহোৎসবের এই বছরের বিষয়ভাবনা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস। সেই কারণেই ১ মাসেরও বেশি সময় আগে আমন্ত্রণ পেয়েছিল 'তিতুমীর'। কিন্তু গতকাল অর্থাৎ ১৮ তারিখ হঠাৎ জানানো হয়, বাতিল করা হয়েছে সেই শো।
আরও পড়ুন: Soumitra Chatterjee: অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে শ্যুটিং, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ ছবি চলছে নন্দনে
বিস্তারিত জানতে নাটকের নির্দেশন জয়রাজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এবিপি লাইভ। তিনি বললেন, 'ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা'-র তত্ত্বাবধানে প্রতিবছরই সরকারি এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর আগেও আমরা সেখানে নাটক মঞ্চস্থ করেছি। নিয়ম হল, আগে কিছু নিয়ম মেনে মনোনয়ন পাঠাতে হয়, সঙ্গে নাটকের ভিডিওগ্রাফি। কিন্তু আমন্ত্রিত নাটকের কোনও ভিডিওগ্রাফির প্রয়োজন হয় না। সেই নাটক ভাল এটা ধরে নিয়েই আমন্ত্রণ আসে সরকারি তরফ থেকে। আমাদের কাছেও তাই এসেছিল।
কিন্তু আমন্ত্রণ আসার কিছুদিন পর থেকেই বারে বারে ফোন আসতে থাকে আমাদের কাছে। প্রশ্ন করা হয় নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে, চেয়ে পাঠানো হয় চিত্রনাট্য। ওঁরা বার বার জানতে চাইছিলেন, নাটকটি সরকার বিরোধী কি না? আমি জানাই, হ্যাঁ, এটি ব্রিটিশ সরকার বিরোধী। উৎপল দত্তের লেখা নাটক। এরপর আমার থেকে নাটকের ভিডিওগ্রাফি চেয়ে পাঠানো হয়। আমরা আপত্তি জানিয়ে বলি, আমন্ত্রিত নাটকের ভিডিওগ্রাফি পাঠানোর নিয়ম নেই। ওঁরা জানান, সদ্যই তৈরি হয়েছে নতুন নিয়ম। আমাদের কাছে সেই সময়ে কোনও ভিডিওগ্রাফি ছিল না। ১৭ তারিখ শো ছিল। ওঁদের জানাই, কলকাতার শো হলে তবেই নাটকের ভিডিওগ্রাফি করে পাঠাতে পারব। তাতে রাজি হয়ে যান ওঁরা। সেই মতো ১৭ তারিখ তিতুমীরের ভিডিওগ্রাফিও করা হয়। কিন্তু ১৮ তারিখ ওঁরা জানান, ভিডিও না পাঠানোর ফলে আমাদের শো বাতিল করা হয়েছে।'
জয়রাজ আরও জানান, কলাকুশলীদের ট্রেন বা বিমানের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল, যাবতীয় আয়োজনও প্রস্তুত ছিল। আপাতত সেই সমস্ত বাতিল করতে হবে। নির্দেশকের কথায়, 'তিতুমীরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক আমরা মনে করি, উৎপল দত্ত মনে করেন। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন, তাঁদের নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেইজন্যই তাঁরা এই থিয়েটারটাকে ব্যহত করতে চাইছেন আর তাই, ভারত রঙ্গ মহোৎসবে এবার ব্রাত্য 'তিতুমীর'।