পৃথা দাশগুপ্ত, কলকাতা: সোনি লিভে (Soni Liv) ৪ মার্চ মুক্তি পেয়েছে ‘আনদেখি সিজন-২’ (Undekhi Season 2)। একটা খুন। আর তাকে ধামাচাপা দিতে একের পর এক খুন, অপরাধ। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে মানালিতে বিয়ের অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে যায় দুই বোন কনক আর কোয়েল। রিসর্টের মধ্যে ব্যাচেলরস পার্টিতে আটওয়াল কোম্পানির মালিক, সকলের পাপাজি গুলি করে মেরে ফেলে বড়বোন কনককে। ডিএসপি ঘোষ এই দুই মেয়ের খোঁজে মানালিতে আসেন। সেখানেই পরিচয় হয় রিঙ্কুপাজি আর আটওয়াল পরিবারের কালো কারবারের সঙ্গে। ডিসিপির চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, রিঙ্কু পাজির চরিত্রে সুরিয়া শর্মা, পাপাজির চরিত্রে হর্ষ ছায়া। ছোটবোন কোয়েলের চরিত্রে অপেক্ষা পড়ওয়াল। ‘আনদেখি’-র প্রথম সিজন শেষে কোয়েলের অ্যাম্বুলেন্স খাদে পড়ে গিয়েছিল। যে অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছিল আটওয়াল পরিবারের বড়বৌমা তেজি অর্থাৎ আঁচল সিং। সে কেন অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছিল, কীভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হয়, তা দ্বিতীয় সিজিনের শুরুতেই রিক্যাপে বলে দেওয়া হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় পর্ব জুড়ে চলে ফার্মা কোম্পানির আড়ালে ড্রাগ ব্যবসা ও তাকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা। এই প্রেক্ষাপটেই সামর্থের চরিত্রটি ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় সিজনে। যে কিনা ইজরায়েল আর ভারতের ড্রাগ চক্রের মাঝে এক যোগসূত্র। রিঙ্কুর চরিত্রটি এই সিজনে কিছুটা নরম দেখানো হয়েছে। যা দেখে মনে হতেই পারে যে বিয়ের পর সে সংসারি হয়ে উঠছে অথবা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। 'মানি হাইস্ট'-এর বার্লিন হোক বা 'নার্কোস'-এর পাবলো এসকোবার, সমস্ত সিরিজেই দর্শকের কাছে নেগেটিভ চরিত্র অনেক বেশি কাছের। রিঙ্কুও সেইরকমই একটা চরিত্র যার সফল চরিত্রায়ন আর বদলে যাওয়া চরিত্রের পরিভাষার কারণে দর্শকের মনে জায়গা করে নেয় সিরিজের শুরু থেকেই। এক্ষেত্রে সালোনী- শাশ্বত, তেজি-দমন, এমনকী কোয়েল-ডিসিপি ঘোষের থেকে রিঙ্কুপাজী আর পাপাজীর ফ্যান-ফলোইং অনেক বেশি। তবে একটি বিত্তশালী, প্রভাবশালী, পঞ্জাবি পরিবারের কর্তার ব্যভিচার, গৃহহিংসা থেকে নারী বিদ্বেষের বৈধতা নির্মাণে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার যতটা কুকথা ও ভাষার ব্যবহার করেছেন তা কখনও ক্লান্তিকর ঠেকে। প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও সালোনীর সঙ্গে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড ও তার জাস্টিফিকেশনে রিঙ্কুর প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করার পরিবর্তে লঘু করে দেন পরিচালক। ঘরে ঘরে কবীর সিং বা রিঙ্কুর মত চরিত্রকে বিপজ্জনকভাবে মহিমান্বিত করার প্রবণতা এই সিরিজেও চোখে পড়বে। লিঙ্গবৈষম্যর উপাদানগুলো বাদ দিয়ে এই সিজনে রিঙ্কুর প্রতিশোধের থেকে অনুতাপ বেশি গ্রহণযোগ্য হবে মনে করেছেন পরিচালক আশিস শুক্ল। মানালির মত মনোরম আপাত শান্ত লোকেশন বেছে নেওয়া পরিচালকের দূরদৃষ্টি ও মুন্সিয়ানা বলতেই হয়। দ্বিতীয় সিজনে দিব্যেন্দুর দীর্ঘ অনুপস্থিতি চোখে পড়বে। আদ্যন্ত বাঙালি এক চরিত্রের মুখে সংলাপ থেকে গান যেভাবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক তাতে যেকোনও বাঙালি দর্শকের ভাল লাগছে আর অন্য প্রদেশের কাছেও এই চরিত্র সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। আঁচল সিংকে দর্শক ‘ইয়ে কালি কালি আঁখে’-তে যেভাবে দেখেছেন তার থেকে তেজির চরিত্রে অন্যভাবে আবিষ্কার করবেন। যদিও আঁচলের জন্য এরপর বড়লোক পরিবারের কন্যার মতো স্টিরিওটাইপড কাস্টিংয়ের ফাঁদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তিনি এ ধরণের চরিত্রেই অভিনয় করবেন নাকি অন্য ধরণের চরিত্রে নিজেকে এক্সপ্লোর করবেন সেটা তাঁর চয়েস। দুই সিজন জুড়ে অন্যতম বড় প্রাপ্তি অবশ্যই কোয়েলের চরিত্রে অপেক্ষা পড়ওয়াল। তার শরীরী ভাষা থেকে মার্শাল আর্টে পারদর্শিতা, স্বল্প সংলাপ থেকে চোখের ভাষায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন বললেও কম বলা হবে। তৃতীয় সিজন হিমাচল থেকে পঞ্জাবের প্রেক্ষাপটে এগোবে তার আভাস এই সিজনেই স্পষ্ট। সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘আনদেখি’ একটি পুরুষতান্ত্রিক পঞ্জাবি পরিবারের অপরাধ দুনিয়ায় অবাধ বিচরণের সঙ্গে নির্যাতিত মহিলাদের প্রতিশোধের গল্প, যার চিত্রনাট্য, চরিত্রের বুনন এতটাই সফল যে পরের সিজনের জন্য অপেক্ষা করবেন দর্শক।
এবার আসা যাক ‘হোম কামিং’-এর (Home Coming) কাহিনিতে। ‘আমরা’ একটা নাটকের দল, যারা আমি-র কারণে ভেঙে যায়। দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে সবাই গোডোর বাড়িতে একত্রিত হয়। সবার ব্যক্তিগত সমস্যা কীভাবে সকলের হয়ে ওঠে সেই গল্প বলে এই সিনেমা। গোডো চাকরি সূত্রে সান ফ্রান্সিস্কোতে থাকে। দাদুর বাড়িকে হেরিটেজ হোটেলে পরিণত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাবা-কাকা চিঠি লেখেন গোডোকে। শেষবারের মত পুজোর সময় সেই বাড়িতে আসে গোডো। হয় ‘আমরা’-র রিইউনিয়ন। এই ছবিতে গোডোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহম মজুমদার। তুহিনার চরিত্রের নাম রূপী। নবমীর রাতে হঠাৎ রূপীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অবস্থার অবনতি হয়। ৪৫ মিনিটের মধ্যে মারা যান তিনি। সেই রাত থেকে বিজয়া দশমীর দিন অস্থি বিসর্জন পর্যন্ত তার পাশে ছিল বন্ধুরা, নাটকের ভেঙে যাওয়া দলের সদস্যরা। সায়নী গুপ্তের চরিত্রের নাম শ্রী, যার সঙ্গে কলেজ জীবন থেকে ইমরোজের একটা সম্পর্ক ছিল। হঠাৎই ইমরোজ চলে যায় মুম্বই। শ্রী কলকাতা ছাড়াতে চায় না। পুজোয় বহু বছর পর আবার মুখোমুখি হয় দু’জনে। শ্রী আর ইমরোজের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব শুরুতে পারস্পরিক দোষারোপ, রাগ-অভিমানের আগুনে পুড়লেও, শেষে জিতে যায় সম্পর্কের উষ্ণতা। ইমরোজের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হুসেন দালাল যিনি সায়নীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঙ্গত করেছেন। শুভ একজন নামী অভিনেতা যে প্রশ্ন করে আজকের মধ্যমেধার উদযাপনকে। শুভর খ্যাতি যে সেই সেলিব্রেশনেরই ফসল, সে সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল। বলতেই হয়, শুভর চরিত্রে তুষার পান্ডে সফল। পরিচালক সৌম্যজিৎ মজুমদারের গল্পের চলনে কখনও মনে হবে ‘হোম কামিং’ একটা একান্নবর্তী পরিবারের গল্প, যে পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের থেকে মানসিকভাবে শত যোজন মাইল দূরে, কিন্তু বাধ্য হয়ে রয়েছে এক ছাদের তলায়। আবার কখনও মনে হবে এটা রোড ফিল্ম, যেখানে চরিত্রগুলোর সফর ব্যক্তি থেকে সমষ্টির পথে। ‘আমরা’ এমন একটা নাটকের দল যারা শুরুতে একটা কলেজ পড়ুয়াদের ভাবনা-আবেগের মাধ্যম ছিল। হয়ত সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল তাদের উপস্থাপনা। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে সেই দল ভেঙে যায়। উত্তর আধুনিক নাট্য আন্দোলনের সমস্ত বৈশিষ্ট্য এই দলের মধ্যে মজুত ছিল। অ্যাকাডেমি থেকে জ্ঞানমঞ্চের দিকে এগিয়েও লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ার কারণটা অনেকটা অর্থনৈতিক, আবার কিছুটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকও। অর্থনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির দ্বৈরথের অচলায়তন ভাঙতে পারেনি এরাও। সেই পরিচিত ভয়, পাছে তাদের শিল্পীসত্ত্বায় দাগ লাগে। এই মিউজিক্যাল রিইউনিয়ন দেখতে দেখতে কখনও মনে হতেই পারে এই মানুষেরা চেনা। আবার অনেক সময় চেনা মানুষের দল অচেনা হয়ে ওঠে। সিনেমার চলনে পরিচালক এই চেনা-অচেনার গণ্ডি বারবার ভেঙেছেন নৈপুন্যের সঙ্গে। কিন্তু যেটা চিনে নিতে একটুও কষ্ট হবে না, তা হল কলকাতার প্রতি ভালবাসা। শহর কলকাতার অতীতকে নিয়ে ভবিষ্যতে পাড়ি দেওয়ার চলমান বর্তমান। প্লাবিতা বরঠাকুরের চরিত্র নার্গিস কলকাতাকে ব্যখ্যা করে এই বলে যে এই শহরের লোকজন পথভোলা হলেও, দিকভ্রষ্ট কখনও নয়। এ শহর জানে রাস্তা কখনও ভুল হয় না, হতে পারে না কারণ এখনও এ শহরের মানুষ স্বপ্ন দেখার সাহস রাখে। কলকাতা সূর্যের মতো, যা কোনওদিন পুরনো হয় না। শেষে কোথাও রক্তকরবীর নন্দিনীর দৃঢ় বিশ্বাস প্রতিফলিত হয় নার্গিসের মধ্যে, যে বলে এই মিছিল বদল আনবেই। রাস্তাই লক্ষ্য। গোটা সিনেমা জুড়ে একটা পরিকল্পিত অবিন্যস্ত ট্রিটমেন্ট লক্ষণীয় যা এই সিনেমার ইউএসপি।
এবার আসা যাক 'রুদ্র দ্য এজ অব ডার্কনেস'-এর (Rudra: The Edge of Darkness) কথায়। ব্রিটিশ সিরিজ 'লুথার'-এর অনুসরণে এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ডিজনি প্লাস হটস্টারে (Disney Plus Hotstar) মুক্তি পেয়েছে ৪ঠা মার্চ। ডিসিপি রুদ্র প্রতাপ সিংয়ের চরিত্রে অজয় দেবগন দর্শক টানার চেষ্টা করলেও চিত্রনাট্যের দুর্বলতা ও সিরিজের অতি নাটকীয়তা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হল। এই সিরিজের মাধ্যমে অজয় দেবগন ওটিটিতে অভিনয় শুরু করলেন। ইদ্রিস এলবার সঙ্গে দর্শক তুলনা করলে হতাশ হবেনই। প্রতিটি এপিসোডে এতটাই ঘটনার ঘনঘটা যে দর্শক খেই হারিয়ে ফেলতেই পারেন। এষা দেওল অভিনয় করেছেন রুদ্রর স্ত্রীর ভূমিকায়। অজয়ের বসের ভূমিকায় অশ্বিনী কালসেকর, অতুল কুলকার্নি অজয়ের সহকর্মীর ভূমিকায়। সিনিয়র পুলিশ অফিসরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আশিস বিদ্যার্থী। একঝাঁক ভাল অভিনেতাদের যেন একমাত্র উদ্দেশ্য অজয় দেবগনকে লার্জার দ্যান লাইফ (larget than life) দেখানো, সিরিজের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। দর্শকের প্রতি তো নয়ই। সিরিজের শুরু থেকেই চেনা ছকে গল্প এগোতে শুরু করল। কখনও কখনও পেস বিল্ডিংয়ের চেষ্টা করেও গতানুগতিক পথে এগোতে থাকল সিরিজ। মুম্বইয়ের প্রেক্ষাপটে সিরিজ তৈরি হল, কিন্তু শহরকে কোনও চরিত্র করে তুলতে পারলেন না পরিচালক। ক্রাইম ব্রাঞ্চের জিজ্ঞাসাবাদ সাতের দশকের পুলিশের ধাঁচে হয়ে গেল। না আছে সূক্ষ্মতা না আছে বিস্তার। পরিচালকের কাজের মধ্যে দায়বদ্ধতা কম, দায়সারা ভাব স্পষ্ট। এর মধ্যে অবশ্যই বলতে হয় রাশি খন্নার চরিত্রে আলিয়া চোকসির অভিনয় অনবদ্য। এরপরে তাঁকে অন্য সিনেমা বা সিরিজে দেখার আগ্রহ তৈরি হবে দর্শকদের মনে। একজন সোসিওপ্যাথের চরিত্রের শেডস ও জটিলতা সফলভাবে তুলে ধরেছেন আলিয়া। এছাড়া এই সিরিজ থেকে প্রাপ্তি খুব বেশি কিছু নেই। যাঁরা 'লুথার' দেখেছেন তাঁদের জন্য তো নয়ই, এমনকী 'ব্রডচার্চ', 'রিট্রিবিউশন' বা 'বডিগার্ড'-এর মত ব্রিটিশ সিরিজের সঙ্গে পরিচয় থাকলে এই অ্যাডপটেশন দুর্বল লাগবে। ‘রুদ্র দ্য এজ অব ডার্কনেস’-এর মধ্যে টিভি ধারাবাহিক সিআইডির প্রভাব বেশি চোখে পড়বে। বলাই যায় অপরাধ জগতের ডার্কনেস এজ ওল্ড ছকে পড়ে হারিয়ে গেল রুদ্র।