কলকাতা: গ্যাসের (Gastric Problem) সমস্যা ভেবে হৃদ্রোগের চিকিৎসা (Heart Attack) এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা! সেই কারণেই কি বড় বিপদ এড়ানো যাচ্ছে না? গোড়াতেই রয়েছে গলদ, অন্তত এমনইটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি কেকে-র অকালমৃত্যু এক ভয়ঙ্কর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে সকলকেই।
দীর্ঘদিন ধরে বুকে চাপ, অস্বস্তি অনুভব করতেন গায়ক কেকে (Singer K K) এবং নিজে নিজেই অ্যান্টাসিড (Antacid) খেতেন, যেটা প্রায় সকলেই জীবনের কোনও না কোনও সময় করেছেন। বুকে ব্যথা? অ্যান্টাসিড। চাপ লাগছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? একটা ব়্যানট্যাক খেয়ে নিলেন। এভাবে সেল্ফ-মেডিকেশন করতে করতে অযথা 'গোল্ডেন পিরিয়ড' নষ্ট করে ফেলেন অনেকেই।
তাহলে করণীয়? কীভাবে বুঝবেন বুকে ব্য়থা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? কখন সতর্ক হতে হবে আপনাকে? এ নিয়ে এবিপি লাইভকে (ABP Live) বিস্তারিত জানিয়েছেন ডাঃ সুশান মুখোপাধ্যায় (Chief of Cardiac Surgery Services - Minimally Invasive Cardiac Surgeon. Apollo)।
হার্টের ব্লকেজ (Heart Blockage) কখন?
হার্টের প্রতিটা ধমনীর নির্দিষ্ট অঞ্চল রয়েছে। একটা আর্টারি বা ধমনী তার নিজের অঞ্চলেই রক্ত সরবরাহ করতে পারে। এবার কোনও আর্টারি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে সেই জায়গার পেশি ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে। এর ফলে বুকে ব্যথা ও অস্বস্তি বোধ হয়। এ ক্ষেত্রে কখনও প্রচন্ড ব্যথা এবং কখনও শুধুমাত্র অস্বস্তি বোধ হতে পারে। এর সঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা, হাতের ব্যথা, গলায় অস্বস্তি হতে পারে। ব্যথা ছড়াতে থাকে বাঁ দিকে। এগুলি সবটাই রেফার্ড পেইন (ব্যথার প্রকৃত উৎসস্থলের বদলে শরীরের অন্য জায়গায় ব্যথা অনুভব হওয়া) হিসাবে হাজির হয়। সেই সময়ে সাধরণতা যখন হার্টের একটি করোনারি ধমনী সরু হয়ে হার্টের পেশিতে রক্ত সঞ্চলনের ব্যাঘাত ঘটে ফলে এই ধরনের সমস্যা হয়।
ঝুঁকি কখন?
- ৪০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তি
- কোলেস্টেরল (Cholesterol)
- উচ্চরক্তচাপ (High Blood Pressure)
- সেডেন্টারি লাইফস্টাইল (Sedentary Lifestyle)
- অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান করেন এমন ব্যক্তি (Smocking And Drinking)
- যাঁর পরিবারে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে
এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি (Risk Factor) যাঁদের রয়েছে তাঁদের সামান্য সমস্যাতেও সময় নষ্ট করা উচিত নয় এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর হৃদ্যন্ত্র এবং রক্তের কিছু পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
কীভাবে বুঝবেন আপনার বুকের ব্যথা গ্যাসের নয়, হার্টের... উপসর্গ কী কী
হার্ট অ্যাটাকে (Heart Attack) বুকে ব্যথার থেকেও বুকে চাপ এবং অস্বস্তি অনুভব করাটা প্রধান উপসর্গ। এ ছাড়াও পেট শক্ত হয়ে আসা, বারবার ঢেকুর ওঠা ইত্যাদিকে নেহাত অম্বল ভেবে ভুল করলে বিপদ ডেকে আনবেন। এই ধরনের উপসর্গ যদি ১০-১৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় সে ক্ষেত্রে কালক্ষেপ না করেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়াও রাতে বুকে চাপ অনুভব করে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া, আর ঘুম না আসা, ঘুম থেকে উঠে কষ্ট ইত্যাদি একেবারেই অ্যাসিডিটির সমস্যা নয়। মনে রাখতে হবে খুব সিভিয়র প্যানক্রিয়াটাইটিস বা ওই ধরনের সমস্যা ছাড়া রাত্রিবেলায় বুকে ব্যথা বা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে জেগে ওঠার ঘটনা সচরাচর ঘটে না। এ ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে সেটা গ্যাসের ব্যথা নয়, হার্টজনিত সমস্যা।
একদিন বুকে ব্যথা হলে তা অবশ্যই ভয়ের নয়। তবে দু থেকে তিনদিন এই উপসর্গ দেখা দিলেই সতর্ক হন। হৃদ্রোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছনোর আগে এক বা একাধিক সঙ্কেত দেয়। হাঁটতে গিয়ে বুকে চাপ, খাওয়ার সময়ে বুকজ্বালা ইত্যাদি সমস্যাগুলো পর পর দু-তিনদিন দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত। আর রিস্ক প্রোফাইলের অন্তর্ভুক্ত হলে অর্থাৎ ঝুঁকি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যখন শরীর চর্চা করছেন বা সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন বা খাচ্ছেন অর্থাৎ যখন স্ট্রেসফুল কোনও কাজ করছেন তখন বুকে চাপ অনুভব করলেন। এবার একটু বিশ্রাম নিতেই যখন শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা কমে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেল এবং তখন ব্যথাও কমে গেল। এটাকে বলে অ্যাঞ্জাইনা। এই ব্যথাকে গ্যাস বা অম্বলের সাধারণ ব্যথা ভেবে ভুল করে থাকেন রোগী। এর পর যখন রক্ত সঞ্চালন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়।
অ্যান্টাসিডের রমরমা
ওভার দ্য কাউন্টার অ্যান্টাসিড খেয়ে পরিস্থিতি জটিল করবেন না। আজকাল যে ধরনের অ্যান্টাসিড কিনতে পাওয়া যায় তা খুব সীমিত সংখ্যক ব্যবহার করার জন্য। তবে আইনি বাধা না থাকায় যে কেউ যে কোনও পরিস্থিতিতে তা কিনে খেয়ে নিতে পারেন। যার দীর্ঘমেয়াদি ফল খুব খারাপ হয়।
ডাঃ অনিকেত চট্টোপাধ্যায় (MBBS, SSKM) বলছেন, 'কেকে শো-এর দিন ১০টা অ্যান্টাসিড বড়ি খেয়েছিলেন! কতটা অবৈজ্ঞানিক একটা উপায়! এ থেকেই প্রমাণ হয়, বেসিক হেল্থ এডুকেশন না থাকার কারণে প্রিভেন্টেবল রোগেও মৃত্যু অবধারিত। হৃদপিণ্ডের রক্তনালীর যার প্রায় পুরোটাই বন্ধ, সে আজ এত বছর ধরে কী খায়? হোমিওপ্যাথি আয়ুর্বেদ ওষুধ আর 'গ্যাসের বড়ি'!
আজ বুকে ব্যথার সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট হলে হেসে-খেলে বেঁচে থাকতে পারতেন কেকে, কিন্তু বুকে যে কোনও সমস্যা হলেই ভারতীয়রা একটাই রোগ বোঝেন-'গ্যাস'!
আমরা প্রতিনিয়ত আউটডোরে এরকম 'গ্যাসের রোগী' দেখতে পাই, তা যে বিভাগের আউটডোরই হোক না কেন! সবকিছুর মূলে গ্যাস, এই ভাবনা রয়েছে ভারতের প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে — এই Gas Syndrome কে তাই Culture Bound Syndrome এর মধ্যে ধরা হয়। এর বিশেষ শারীরিক ভিত্তি নেই, রয়েছে মানসিক ভিত্তি ও অপরিমিত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন।
আরও পড়ুন: KK Demise : 'আশপাশের মানুষগুলো ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলে হয়তো মানুষটাকে হারাতাম না', আফশোস চিকিৎসকদের