পায়েল মজুমদার, কলকাতা: চলে গিয়েও সে যেন পুরোপুরি চলে যায় না। গত বছরের শেষাশেষি থেকে ফের চোখ রাঙাচ্ছে নভেল করোনাভাইরাস (covid19)। চিন তো বটেই, জাপান, ব্রাজিল, আমেরিকা-দিকে দিকে ফের তার চোখরাঙানি। আর এতে অশনি সঙ্কেত দেখছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের (psychiatrist) অনেকে। কারণ? সংক্রমণ ঠেকাতে নিয়ম করে সাবান (soap) ও জল (water) কিংবা স্যানিটাইজার (sanitizer) দিয়ে হাত ধোয়া জরুরি। কিন্তু যাঁদের আগে থেকেই বার বার হাত ধোয়া, জামাকাপড় মাত্রাতিরিক্ত কাচাকাচির মতো সমস্যা রয়েছে তাঁরা এই সময়টা কী করবেন? তাঁদের জন্য কি বিপদটা আরও বেশি নয়? মনোরোগের দুনিয়ায় এই সমস্যার নাম অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি (OCD)। এবং মনোবিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, করোনার ঢেউ নতুন করে আছড়ে পড়ার অর্থ এই ধরনের সমস্যা আরও বাড়বে।


কেন আশঙ্কা?
আমাদের দেশে এ পর্যন্ত যে কটি ঢেউ এসেছে, তাতে মনোবিদদের একাংশের অভিজ্ঞতা ওসিডি-র সমস্যা বেড়েছে। ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক ও মনোবিদ প্রশান্তকুমার রায় যেমন এক তরুণের কথা বললেন। কোয়ারান্টিনে তখন বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। কিন্তু সেই তরুণের মনে সংক্রমণের ভয় এতটাই মারাত্মক অবসেশনের চেহারা নিয়েছিল যে উদ্বেগ কমাতে তিনি দিনভর নিজের ঘর থেকেও বেরোতেন না। পাছে বাড়ির বাকি লোকেদের থেকে তাঁর দেহে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, এই ভয়ে দিনের সিংহভাগ সময় নিজের ঘরে তালাবন্ধ থাকতেন। একমাত্র বাড়িতে কেউ না থাকলে নিজের ঘর থেকে বেরোতেন তিনি। এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অতিমারি যখন তুঙ্গে, তখন অধ্যাপক রায় এমন ঘটনাও দেখেছেন যখন প্রত্যেক দিন টানা ৪-৫ ঘণ্টা স্রেফ কাচাকাচি করে সময় কাটাচ্ছেন আর এক ওসিডি আক্রান্ত। এক জন আবার সংক্রমণের উদ্বেগ এড়াতে এত বার স্যানিটাইজার ব্যবহার করেছেন, যে চামড়ায় ঘা তৈরি হয়ে গিয়েছে।


ওসিডি কী?
আমেরিকান সাইকোলিজাল অ্যাসোসিয়েশন বা এপিএ-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটি এমন একটি অসুস্থতা যার দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমটি অবসেশন, যেখানে বার বার কোনও উদ্বেগজনক ভাবনা ঘুরেফিরে মনে চলে আসতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুতেই সেই ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন না। আর সেই ভাবনার থেকে তৈরি উদ্বেগ কমাতে তিনি একই কাজ বার বার করতে থাকেন। এটি দ্বিতীয় অংশ যার নাম কমপালশন। করোনার সময় সংক্রমণের ভয় বহুক্ষেত্রে এই উদ্বেগজনক অবসেশনের ভূমিকা নিয়েছিল। আর সেই উদ্বেগ কমাতে কেউ কেউ ধোয়াধুয়ি, কেউ মোছামুছির মতো কম্পালসিভ কাজকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। পরিসংখ্যান বলছে, অতিমারি-পূর্ব দুনিয়াতেও ওসিডি খুব অজানা রোগ নয়। বহু ক্ষেত্রে আমরা একে বাতিকগ্রস্ততা বলে এড়িয়েও যাই। কিন্তু অতিমারি এসে মূলত দুটি সমস্যা তৈরি করেছে। অধ্যাপক-মনোবিদ রায়ের মতে, 'যে কোনও সামাজিক স্ট্রেস বাড়লে এই ধরনের রোগের হার বাড়ে। করোনার সময় ওসিডি আক্রান্তদের একাংশের মধ্যে দেখেছি উপসর্গের তীব্রতা বেড়েছে, অনেকের মধ্যে নতুন করে উপসর্গ তৈরিও হয়েছে।' 


রয়েছে ভিন্নমত...
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-অধ্যাপক সৈকত বৈদ্যের অভিজ্ঞতা অবশ্য আলাদা। তিনি বললেন, 'আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, যে অতিমারির সময়ে ওসিডি আক্রান্তদের একটা বাড়বাড়ন্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি।' তাঁর মতে, আরও বহু আশঙ্কার মতো এটিও সে অর্থে তেমন মাথাচাড়া দেয়নি। তাই ভবিষ্যতেও এরকম কোনও অশনি সঙ্কেত রয়েছে বলে এই মুহূর্তে মনে করেন না এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। যদিও মনোবিদদের একাংশ অন্য কথা বলছেন। 


পরিসংখ্যান...
চিনের যে উহান শহরে প্রথম করোনা আক্রান্তের হদিস মিলেছিল, সেখানে ২০২০ সালের জুলাই মাসে একটি সমীক্ষা হয়। তাতে দেখা যায়, সমীক্ষায় যাঁদের নেওয়া হয়েছিল তাঁদের ১৭.৯৩ শতাংশের মধ্যেই ওসিডির উপসর্গ তৈরি হয়েছে। কিছুটা এক ছবি উঠে এসে জার্মানি, ইরানেও। এখন নতুন করে করোনার বাড়বাড়ন্তের ফলে সংক্রমণ এড়ানোর জন্য ফের নিয়মবিধিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন হালে ফের সংক্রমণ ঠেকাতে নিয়ম করে সাবান ও জল কিংবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ওসিডি আক্রান্তদের কী ভাবে সাহায্য় করা সম্ভব?


পরামর্শ...
মনোবিদ প্রশান্তকুমার রায়ের মতে, এখনকার যা পরিস্থিতি তাতে এটা মেনে নেওয়া দরকার যে এই হাত ধোওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই আক্রান্তের আচরণ যে পুরোপুরি অযৌক্তিক, সেটা বলার জায়গা নেই। সেটি প্রথমে তাঁকে বলে নেওয়া দরকার। কিন্তু এর পর তাঁর সঙ্গে করোনা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। জেনে নেওয়া দরকার, করোনা ও সংক্রমণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জানা ও বোঝার মধ্যে কোথায় অসঙ্গতি রয়েছে। সেই অসঙ্গতি যাতে তিনি নিজেই বুঝে সংশোধন করতে পারেন, সেই মতোই এগোনো প্রয়োজন বলে মনে করেন মনোবিদ রায়। এক্ষেত্রে একটি জিনিস মনে রাখা দরকার। কম-বেশি এই ধরনের উপসর্গ হয়তো আমাদের অনেকেরই আছে। একাধিক বার হাত ধোয়া, আভেন বন্ধ করা হয়েছে কিনা একাধিক বার দেখা, ফ্যানের সুইচ নেভানো কিনা সেটি 'চেক' করা, এগুলি কম-বেশি আমরা অনেকেই করি। কিন্তু তার অর্থ এটি নয় যে আমাদের প্রত্যেকেরই বিশেষ কোনও সমস্যা আছে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পর যখন এই ধরনের আচরণ কারও স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত করে, তখনই সেটি নিয়ে ভাবা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এবং অতিমারিতে এই ধরনের ঘটনা হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। তাই বাতিকগ্রস্ত বলে দূরে সরিয়ে রাখা নয়, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য় নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।


আরও পড়ুন:রাজ্যের মিড-ডে মিলে এবার মুরগির মাংসও, বরাদ্দ অতিরিক্ত