কলকাতা: দেশের উপদ্রুত এলাকায় বছরভর থাকে সেনাদের অতন্দ্র প্রহরা। প্রতিরক্ষাবাহিনীর হাজার জোড়া চোখ থাকে । সেই জন্যই বড়সড় নাশকতার ছক ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়। হার্টের অসুখের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। আগে থেকে সতর্ক না হলে হঠাতই একদিন ঘটে যেতে পারে বিপদ , তা আটকানো কঠিন হবে। কবে বুকের যন্ত্রণা হবে, তার অপেক্ষায় বসে থাকাটা বিপজ্জনক ! ওয়ার্ল্ড হার্ট ডে - তে বার্তা চিকিৎসক কুণাল সরকারের (Senior Vice Chairman, Senior Cardiac Surgeon & Head , Medica Superspecialty Hospital, FRCS (ED), FRCS (Glasgow), MNMS)


ABP Live কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ডা. কুণাল সরকার জানালেন, ' চিন্তায় ফেলছে কম বয়সে হার্টের রোগীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেরাই দায়ী। বর্তমান জীবনযাত্রায় যতই চাইনা কেন, তপোবনের শান্তি তো চাইলেও পাওয়া যাবে না! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন তো আসবেই। তাই এমন কিছু উপদেশ দেওয়া উচিত নয়, যা সম্ভব নয় ! তবে আমরা যদি হার্টকে শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষি, তাহলে হার্ট ভাল থাকবে কী ভাবে ? অর্থাৎ সব জেনেশুনেও কমবয়স থেকে সচেতন হন না বহু মানুষ । যেমন , নিজের ওজন সম্পর্কে উদাসীনতা, মাঝ তিরিশে পৌঁছে গিয়েও নির্দিষ্ট সময়ান্তর ব্লাড প্রেসার বা সুগার না মাপানো , ক্ষতি ডেকে আনে চুপিসাড়ে। ভিতরে ভিতরে ক্ষতি হয়ে যায়। মানুষের খেয়ালই হয় না। আমরা অবসরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুবান্ধবের স্টেটাস দেখি, তা নিয়ে আলোচনা করি, কিন্তু সময় মতো নিজের শরীরের স্টেটাসটাই চেক করি না। ' 
ডা. সরকারের মতে মাঝ তিরিশ বয়স হলেই , কয়েকটি জিনিস নজরে রাখতে হবে। যেমন - 



  • বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের মতোই কী হাঁটা চলা করতে পারি? 

  • শরীরের উচ্চতা ও ওজন সামঞ্জস্যপূর্ণ তো ? 

  • ব্লাড প্রেসার নরম্যাল তো ? 

  • ব্লাড সুগার কিন্তু সায়লেন্ট কিলার। তাই রক্তে শর্করার মাত্রা মাপতে হবে। 

  • ধূমপান  ত্যাগ করতে হবে। ডা. সরকারের মতে , '৫০, ৬০ , ৭০- এর দশকে তো ধূমপানকে শরীরের আবরণ করে ফেলেছিলাম। ধূমপানকে পুরুষত্বের প্রকাশ, স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। ছেঁড়া জিন্স, মাথায় টুপি আর ঠোঁটে ঝোলানো সিগারেট- এই স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়ে মাতামাতি করেছি আমরা। কিন্তু এই  মাতামাতি করে সেই আগুনে আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারলাম। '

  • ডা. সরকারের কথায়, ' অ্যালকোহল সেবনও এখন অনেকের কাছে আর্বানাইজেশনের আইকন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অ্যালকোহল বেশি মাত্রায় খেলে হার্টের ক্ষতি। তাতেও দরকার পরিমিতি বোধ দরকার।' 


  • ডা. সরকারের মতে, তবে এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন Substance Abuse-এ। কাজের চাপের অজুহাত দিয়ে সিগারেট অ্যালকোহলে ডুব দিচ্ছে যুবসমাজের একাংশ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা মাদক সেবনও করছে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে জমায়েতে। সেটাকেও তাঁরা জীবনের অঙ্গ হিসেবে ধরে নিচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের তরফে ধরপাকড় হলেও শহুরে যুবাদের অনেকের পকেটেই পৌঁছে যাচ্ছে মাদক। এক্ষেত্রে পরিবারের মধ্যে আলোচনা প্রয়োজন, তাঁদের বোঝানো দরকার। নিজেদের মধ্যে ওপেন গ্রুপ ক্রিয়েট করে মাদক সেবনের ক্ষতি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।




  • এই জেনারেশনের অনেকে  শারীরিক সচেতনতা বোঝাতে জিমে গিয়ে কসরত করছে দুইবেলা, প্রতিনিয়তই তারা মাপছে মাসলের পুঙ্খানুপুঙ্খ। অথচ সপ্তাহ শেষে গিয়ে নিচ্ছে মাদক। গাঁজা, কোকেন, হেরোইনে মেতে আছে যুবাদের একাংশ। প্রেসার নিয়ে কাজ করা মানেই মাদক নিয়ে রিল্যাক্স করা নয়! আর্থিক স্বচ্ছলতার সঙ্গে দাম্ভিকতা ও উন্নাসিকতা কেন আসবে? প্রশ্ন তোলেন ডা. কুণাল সরকার। 



  •  এখন কো বেশিরভাগই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি! কথা বলার লোক তো কম। তাই আঘাত সহ্য করার ক্ষমতাও কমছে। 

    এবিপি লাইভের সঙ্গে আলোচনায় ডা. সরকার জানালেন, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু  প্রথম উপসর্গ দেখা দেওয়া মানে, ' ইট ইজ টু লেট। অনেক দেরি হয়ে গেছে, বুকে ব্যথা হলে ডাক্তার দেখাব, এটা আজকের মন্ত্র হওয়ার কথা হয়। আগে থেকেই জানতে হবে ব্লাডের বিভিন্ন প্যারামিটার ঠিক আছে কি না, ব্লাড সুগার কত, ব্লাড প্রেশার নর্ম্যাল কি না। ইকো-ইসিজি করে নিজের শরীরকে জেনে রাখতে হবে ৩০ পেরলেই। কবে বুকে ব্যথা হবে, তার অপেক্ষা করলে বিপদের শেষ থাকবে না। কোথাও কোনও সমস্যার পূর্বাভাস পেলে তৎক্ষণাৎ ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। 

  • রুটিন ব্লাড টেস্ট, সুগার, কোলেস্টেরল, লিভার ফাংশনের টেস্ট, ট্রেডমিল টেস্ট করাতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে। ৪৫ পেরলে ৪-৫ বছরে একবার হার্টের সিটি স্ক্যান করানো আবশ্যক। 

  • ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। ডাাবেটিস কিন্তু হার্ট, চোখ, কিডনির ক্ষতি করে আস্তে আস্তে

  • তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের নির্দিষ্ট সময়ান্তর ইসিজি ( electrocardiogram ECG), টিএলসি (TLC is Total Leukocyte Count)পরীক্ষা করানো দরকার। 

  • কবে বুকে ব্যথা হবে, পাড়ার সকলে তুলে ধরে হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে, তার অপেক্ষা করে থাকাটা তো বোকামি। 

  • সচেতনতা মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের মধ্যেও থাকুক। চিকিৎসকদের ক্রমাগত রোগীদের সচেতন করতে হবে।
    এই বিষয়ে খুব সুন্দর একটি উদাহরণ দিলেন ডা. কুণাল সরকার। তিনি বললেন, 'হার্ট মায়েদের মতো। সন্তান অনেকক্ষণ ধরে বিরক্ত করার পরই হয়ত ধৈর্য হারিয়ে মা চড়টি মারেন। অর্থাৎ বুকে ব্যথা-যন্ত্রণা  হওয়া মানে ক্ষতিটা শুরু হয়ে গিয়েছে অনেকদিনই। '