নয়াদিল্লি: সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা কোনও রাজ্যে। কোনও রাজ্য আবার ভৌগলিক এবং রাজনৈতিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। আজ লোকসভা নির্বাচনের ফলঘোষণা। ৫৪৩ আসনের কোনটিতে, কোন দল জয়ী হল, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন NDA, নাকি বিজেপি বিরোধী I.N.D.I.A, আগামী পাঁচ বছরের জন্য মসনদ কার দখলে থাকবে, তা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে কিছু রাজ্য। (Lok Sabha Elections 2024 Results)


পশ্চিমবঙ্গ: এবারের লোকসভা নির্বাচনে গোড়া থেকেই পশ্চিমবঙ্গ,কে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। ২০১৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল ২২টি আসনে জয়ী হয়েছিল, বিজেপি জয়ী হয় ১৮টি আসনে। এবারে ৩০টির বেশি আসনে জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন অমিত শাহ, তার জন্য প্রচারে কোনও খামতি রাখেনি গেরুয়া শিবির। দফায় দফায়, এমনকি শেষ দফায় ভোটগ্রহণের আগেও পশ্চিমবঙ্গে প্রচার করতে দেখা গিয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, হিন্দি বলয়ের বাইরে দলের প্রভাব বিস্তার করতে পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণ ভারতই সহায় হতে পারে বিজেপি-র। মহারাষ্ট্র এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে কিছু আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বিজেপি-র, যা পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুষিয়ে নিতে চাইছে তারা। (Key States in Lok Sabha Elections)


২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেও এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি-র কাছে। এর আগে, ২০২১ সালে ২০০-র বেশি আসনের লক্ষ্য থাকলেও, ৭৭ আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। ফের যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয়, এখন থেকেই উঠেপড়ে লেগেছেন বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্ব। তৃণমূলের বিরুদ্ধে আগ্রাসী প্রচার চালিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারেরা। বুথফেরত সমীক্ষায় এখনও পর্যন্ত বিজেপি-ই এগিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তারা ২৭টি আসন জিততে পারে বলে মিলেছে ইঙ্গিত। তৃণমূল যদিও সমীক্ষার রিপোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। 


মহারাষ্ট্র: গত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এবং উদ্ধব ঠাকরে নেতৃত্বাধীন শিবসেনা জোটসঙ্গী ছিল। ৪৮টির মধ্যে রাজ্যের ৪১টি আসনে জয়ী হয় তারা। কিন্তু এবার শিবসেনা দু'টুকরো হয়ে গিয়েছে। উদ্ধবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন একনাথ শিন্ডে। সংখ্যার জোরে শিবসেনার প্রতীকচিহ্নও তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। উদ্ধবকে কার্যতই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। একই ভাবে শরদ পওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিও দুই গোষ্ঠীতে ভেঙে গিয়েছে। সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে ভাইপো অজিত পওয়ার NDA-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।


অর্থাৎ NDA এবং I.N.D.I.A, দুই শিবিরেই শিবসেনা এবং NCP-র একটি করে অংশ রয়েছে এই মুহূর্তে। ফলে তাদের ভোটব্যাঙ্ক ভাগ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা কার হচ্ছে, তবে কে লাভবান হবে তাকে, তা বোঝা যাবে ফলাফল ঘোষণার পরই। তবে মহারাষ্ট্রে যদি ভাল ফল করতে পারে I.N.D.I.A জোট, সেক্ষেত্রে রাজ্যে বিজেপি-র মোকাবিলা করা আরও সহজ হয়ে উঠবে শিবসেনা (উদ্ধব), NCP (শরদ) এবং কংগ্রেসের মহা আঘাডি জোটের জন্য। ২০১৯ সালের নিরিখে এবার মহারাষ্ট্রে NDA-র আসন কমলেও, বিজেপি-র জয় আটকাবে না বলে যদিও ইঙ্গিত মিলেছে বুথফেরত সমীক্ষায়। কিন্তু I.N.D.I.A জোট সেই সমীক্ষা মানতে নারাজ।


ওড়িশা: পূর্বের আরও একটি রাজ্য, ওড়িশা নিয়েও আশায় বুক বাঁধছে বিজেপি। ওড়িশায় বরাবরই নবীন পট্টনায়েক এবং তাঁর বিজু জনতা দলের আধিপত্য। লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই এবার সেখানে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওড়িশায় BJD ২১টি আসনে জয়ী হয়েছিল, বিজেপি পেয়েছিল আটটি আসন। এবার ওড়িশায় একক বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসার লক্ষ্য় নিয়েছে গেরুয়া শিবির। BJD-র সঙ্গে তাদের পুরনো সমীকরণেও ফাটল ধরেছে। বুথফেরত সমীক্ষায় সেখানে বিজেপি-কে এগিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও BJD সেই সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছে পত্রপাঠ।


বিহার: লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি যখন শুরু হয়, I.N.D.I.A শিবিরেই ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এমনকি বিরোধী শিবিরের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবেও কেউ কেউ তুলে ধরছিলেন তাঁকে। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে আবারও শিবির বদল করে NDA-তে যোগ দেন তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ও NDA-তে ছিলেন নীতীশ। সেবার রাজ্যের ৪০টি আসনের মধ্যে ৩৯টিতে জয়ী হয় NDA. কিন্তু বার বার নীতীশের এই শিবিরবদলে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই নীতীশের উপর ভর করে বিজেপি কতটা লাভের গুড় ঘরে তুলতে পারবে, সেই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অন্য দিকে, লালুপ্রসাদ যাদবের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের আলাদা রাজনৈতিক পরিচিতি গড়ে তুলতে সফল হয়েছেন ছেলে তেজস্বী যাদব। কংগ্রেস, CPI, CPM, CPI-ML-এর সঙ্গে I.N.D.I.A জোটে রয়েছেন তিনি। রাহুল গাঁধী এবং তেজস্বী একসঙ্গে প্রচারও করেছেন। ২০১৯ সালে বিজেপি-র ৩০৩টি আসন পাওয়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বিহারের। এবার তার পুনরাবৃত্তি হয় নাকি, উল্টোটা ঘটে, তা জানা যাবে আজই।


তেলঙ্গানা: গতবছর বিধানসভা নির্বাচনে তেলঙ্গানায় অভূতপূর্ব সাফল্য পায় বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেসি রায়ের দল রাজ্যে ১৭টির মধ্যে ন'টি আসনে জয়ী হয়েছিল। বিজেপি চারটি এবং কংগ্রেস জিতেছিল তিনটি আসন। এবার কেসিআরের দল ভারত রাষ্ট্র সমিতির ভোট নিজেদের দিকে টানতে মরিয়া ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস। ভোটবাক্সে কে লাভবান হবেন, তা-ই দেখার।


কর্নাটক: এবারের লোকসভা নির্বাচনে কর্নাটক আক্ষরিক অর্থেই প্রেস্টিজ ফাইট কংগ্রেসের জন্য। ২০১৯ সালে সেখানে ২৮টির মধ্যে ২৫টি আসন জিতেছিল বিজেপি। সেই সময় কংগ্রেসের জোটসঙ্গী ছিল JDS, বর্তমানে যারা NDA-তে।  অর্থাৎ কংগ্রেস একা লড়ছে কর্নাটকে। সেখানে কংগ্রেসের সরকার রয়েছে, তার পরও যদি বিজেপি ভাল করে, তা মোটেই সুখকর হবে না। একই ভাবে, কর্নাটকে ভাল ফল হলে, দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবে বিজেপি। বুথফফেরত সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত বিজেপি-কেই এদিয়ে রেখেছে যদিও। তবে কংগ্রেস চমকের অপেক্ষা করছে। 


অন্ধ্রপ্রদেশ: এই লোকসভা নির্বাচনে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রবাবু নায়ডু যদি কামব্যাক করেন, সেক্ষেত্রে বিজেপি-ই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। অন্ধ্রে বিজেপি এবং নায়ডুর দল টিডিপি-র জোট রয়েছে। টিডিপি ১৭টি আসনে লড়ছে, বিজেপি ছয়টিতে এবং পবন কল্যাণের জন সেনা পার্টি দু'টি আসনে লড়াই করছে এবার। অন্য দিকে, জগনমোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস একা লড়ছে। অন্ধ্রেও এবার একই সঙ্গে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। ২০১৯ সালে সেখানে ২২টি আসন জিতেছিল ওয়াইএসআর কংগ্রেস। টিডিপি মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল। এবারে বিজেপি যদি আগের বার জেতা আসনগুলি ধরে রাখতে পারে এবং নায়ডুর প্রত্যাবর্তন ঘটে, সেক্ষেত্রে দিল্লিতে সরকার গড়ার পথে এগিয়ে যাবে NDA. তবে হাল ছাড়ছে না কংগ্রেসও। জগনের বোন ওয়াইএস শর্মিলাকে টিকিট দিয়েছে তারা। বামেরাও তাদের সঙ্গে রয়েছে। 


উত্তরপ্রদেশ: দেশের সর্বাধিক লোকসভা আসন রয়েছে উত্তরপ্রদেশে, ৮০টি। হিন্দি বলয়ে বিজেপি-র আধিপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশ। ২০১৯ সালে সেখানে ৬২টি আসনে জয়ী হয় বিজেপি। সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি যথাক্রমে ১০টি এবং পাঁচটি করে আসন পেয়েছিল। এবার কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টি একসঙ্গে লড়াই করছে। একা লড়ছে বহুজন সমাজ পার্টি। অন্য দিকে, রায়বরেলী, অমেঠীর মতো গুরুত্বপূর্ণ আসনে লড়াই করছে কংগ্রেস। মোদি যেমন বারাণসীতে লড়াই করছেন, রাহুল গাঁধী রায়বরেলীতে প্রার্থী হয়েছেন। সমাজবাদী পার্টি ৬২টি আসনে এবং কংগ্রেস ১৭টি আসনে লড়াই করছে। বিজেপি আপনা দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পাশাপাশি, জয়ন্ত চৌধুরী এবং ওপি রাজভরের দলকেও নিজেদের ছত্রছায়ায় এনেছে তারা। লোকসভা নির্বাচনের আগেই অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে, যা ভোটবাক্সে বিজেপি-কে ডিভিডেন্ড দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবং যোগী আদিত্যনাথের মধ্যেকার শীতল সম্পর্কও খবরে জায়গা করে নিয়েছে। 


এর পাশাপাশি, কেরল এবং তামিলনাড়ুতেও জোরকদমে প্রচার চালিয়েছে বিজেপি। দক্ষিণের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেই বার বার সেখানে ছুটে গিয়েছেন মোদি-অমিত শাহেরা।  কেরলে এবার তাদের খাতা খুলতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে বুথফেরত সমীক্ষায়। তামিলনাড়ুতে AIADMK-র সঙ্গ ছেড়ে ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে তারা। এই কয়েকটি রাজ্যে ভাল ফল করলেই বিজেপি নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। একই ভাবে, এই কয়েকটি রাজ্যে যদি বিজেপি-কে ঠেকিয়ে দিতে পারে বিরোধীরা, তাতেই ভোটের ফল উল্টে যেতে পারে বলে মত তাঁদের।


আরও পড়ুন: I.N.D.I.A Alliance Winners Losers Live Updates: অস্তিত্বরক্ষার লড়াই কারও, কারও প্রেস্টিজ ফাইট, I.N.D.I.A জোটের হেভিওয়েট নেতাদের ভাগ্যপরীক্ষা