তিরুঅনন্তপুরম: প্রবল বৃষ্টির জেরে ধসে বিপর্যস্ত কেরলের ওয়েনাড। লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বুধবার দুপুর পর্যন্ত ১৫৮ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরেই এমন ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। আর সেই আবহেই প্রায় একদশক আগের একটি রিপোর্টের কথা উঠে আসছে। মনুষ্যঘটিত কারণে কেরলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসতে চলেছে বলে ঢের আগেই ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছিল। (Kerala Wayanad Landslide)
কেরলের পরিস্থিতি দেখে এই মুহূর্তে শিউরে উঠছে গোটা দেশ। আর এই পরিস্থিতিতেই পরিবেশবিদ মাধব গডগিলের কথা উঠে আসছে বার বার। কারণ একদশক আগেই কেরলকে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। কেরলের এই বিপর্যয়ের পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, কেরলে যা ঘটছে, চোখের সামনে যা দেখছেন, তা নিয়ে কিছু বলার মতো মানসিক অবস্থা নেই তাঁর। কেরলের বিপর্যেয়র নেপথ্যে মনুষ্যঘটিত কারণ যেমন রয়েছে, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনকেও দায়ী করেন তিনি। (Wayanad Landslide)
কিন্তু ওয়েনাডের চুরামালা এবং মুন্ডাক্কাইয়ে ভয়াবহ ধসের ফলে যে মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছে, তাতে বার বার মাধব এবং তাঁর তৈরি করা রিপোর্টের উল্লেখ উঠে আসছে। ১৩ বছর আগে, ২০১১ সালে মাধবের নেতৃত্বে Western Ghats Exology Expert Panel (WGEEP) কমিটি গঠিত হয়। কেরলে ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তারা। রিপোর্টে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে কেরলে পরিবেশগত ভাবে স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে যেভাবে নির্বিচারে নির্মাণকার্য চলছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে চলেছে। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ওই রিপোর্ট জমা পড়ে। ওয়েনাডের মেপ্পাডিতে পরিবেশের ক্ষতি করে নির্মাণকার্য চলছে বলে জানানো হয় রিপোর্টে। ওই মেপ্পাডিতেই মঙ্গলবার ধস নামে। রিপোর্টে ওয়েনাডের চুরামালা, আট্টামালা, নূলপুঝা, মেপ্পাডিকে পরিবেশগত ভাবে স্পর্শকাতর এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়।
কিন্তু ওই রিপোর্টটি সেই সময় গৃহীত হয়নি। বরং কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে পৃথক একটি রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফের কেরলের পরিস্থিতি নিয়ে সরব হন মাধব। যে, যেখানে পারছে জমি জবরদখল করছে, নির্বিচারে বনভূমি নিধন চলছে, অবৈজ্ঞানিক ভাবে নির্মাণকার্য চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। বছর বছর কেরলে বন্যার জন্যও পরিবেশের উপর এই অত্যাচারকেই দায়ী করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, "পরিবেশ সংরক্ষণে এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে উপযুক্ত আইন রয়েছে। কিন্তু আইন মেনে চলা হচ্ছে না বলেই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে। সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে আমাদের। পরিবেশ রক্ষার্থে মানুষের কিছু বলার অধিকার থাকবে না, এটা অবশ্যপাল্টাতে হবে। দেশে ত্রিস্তরীয় যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রয়েছে, তার আওতায় এই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের অধিকার আছে নাগরিকদের।"
পরিবেশগত ভাবে স্পর্শকাতর এলাকাগুলিকে 'No Development Zone' হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশও দিয়েছিল মাধব নেতৃত্বাধীন কমিটি। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ওই এলাকায় রিসর্ট, কৃত্রিম হ্রদ, গগনচুম্বী ভবন, কিছুর নির্মাণই বাদ যায়নি। মঙ্গলবার যেখানে ধস নেমেছে, তার কয়েক কিলোমিটার দূরেই খনিতে খননকার্য চালানোর ফলেই ধস এত ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে বলে মত মাধবের। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, "সম্প্রতি এক ব্যবসায়ী ওই এলাকাকে পর্যটন এলাকায় পরিণত করতে, কিছু বিল্ডিং নির্মাণ, পরিকাঠানোর উন্নয়নের প্রস্তাব দেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী খোদ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইকোট্যুরিজমের নামে পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে।"
মনুষ্যঘটিত এই বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন, দুইয়ের প্রভাবে ওয়েনাডের পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। যত দিন যাচ্ছে আরব সাগরের উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে। এর ফলে উষ্ণ সাগর থেকে নিঃসৃত তাপশক্তি ক্রান্তীয় ঝড়ঝঞ্ঝার সৃষ্টি করে। অল্প সময়ে অতিবৃষ্টির প্রকোপ দেখা দেয়, যা ভূমিধস ডেক আনে। অ্যাডভান্সড সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রেডার রিসার্চের ডিরেক্টর এস অভিলাষ জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে একটানা ভারী বৃষ্টি চলছে কাসারাগড়, কান্নুর, ওয়েনাড, কালিকট, মলপ্পুরমের মতো জেলায়। এর ফলে মাটি আলগা হয়ে যায়, যার ফলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, ত্রিশূর, পলক্কড়, কোঝিকোড়, ওয়েনাড, কান্নুর, এর্নাকুলামে ১৯ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আগামী কয়েক দিনও বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে তারা।