কলকাতা :  - 'আমার ছেলে বিদেশে থাকে। বিমান চলাচলে বাধা থাকায় দেড় বছর হল আসতে পারেনি। সারা বাড়িতে আমি একা। কী হবে বলুন তো বেঁচে থেকে ?'



  • ' স্বামী করোনায় চলে গেলেন গত বছর। মেয়ে আসতেও পারল না নিউইয়র্ক থেকে। এভাবে হয়ত আমিও কোনওদিন ... '

  • ' ছেলেটার চাকরি চলে গেল। টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। সংসার চলছে না। আমার চিকিৎসা করাতে গিয়ে ওর তো দুইবেলা খাবারও জুটছে না'

    আরও পড়ুন :

    Post Covid Heart Disease In Child : ভাবাচ্ছে শিশুদের কোভিড পরবর্তী হার্টের অসুখ, এই উপসর্গগুলি দেখলেই আর বিলম্ব নয়!



    এই কথাগুলি আপনি কি কারও কাছ থেকে শোনেননি এই লকডাউনে? করোনাকালে আপনার আশেপাশে কজন মানুষ একা একা দিন কাটাচ্ছেন, ভাবার সময় হয় কি আমাদের ? আসলে এই কথাগুলির বক্তা আলাদা আলাদা। তাঁরা হয়ত আমার-আপনার প্রতিবেশীও। কিন্তু এই কথাগুলি তাঁরা বলার সুযোগ পাননি কাউকে। প্রবল মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তাঁরা গিয়েছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। তাই হয়ত ওষুধ ও কাউন্সেলিং-এ সুস্থ হয়ে তাঁরা আছেন আমাদের মধ্যেই। আবার এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা এই কথাগুলি মনের মধ্যে চেপে রেখেছেন, গুমরে গুমরে কেঁদেছেন।  শেষমেষ হয়ত বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। 

    করোনাকালে সার্বিকভাবে আত্মহননের সংখ্যা যে বেড়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই । তবে চিকিৎসকের মতে, এই সময়ে আমাদের দেশে আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়েছে  বয়স্কদের মধ্যে। অনেকেই হয়ত করোনা কালে আরও বেশি করে একা হয়ে গিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন দেশে ফিরতে পারেননি। পাড়াপড়শির সঙ্গে কথাবার্তা বা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাতায়াত কিংবা পাড়ায় আড্ডা দিতে যাওয়া সবই বন্ধ হয়েছে। এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে দখিনের জানলাটিও। একদিকে মন ভাল করার সব জানলাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়া , অন্যদিকে করোনাকালে বাড়তে থাকা জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা, ক্রমে ক্রমে গ্রাস করছে বয়স্কদের। আর এর থেকেই বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা। এর থেকে বাঁচার পথ নিয়ে এবিপি লাইভের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলেন ডা. সুজিত সরখেল। (Indian Psychiatric society - র সুইসাইড প্রিভেনশন বিভাগের কোঅর্ডিনেটর) 

    কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে এই সঙ্কট ? 

    চিকিৎসক সুজিত সরখেল জানালেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন আত্মহত্যা আটকাতে । একদিকে বন্ধ করতে হবে আত্মহত্যা করার মূল উপায়গুলি। অন্যদিকে মানসিকভাবে ভাল রাখতে হবে কাছের মানুষদের। 

  • প্রথমত হাতের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে কীটনাশক জাতীয় জিনিস। শ্রীলঙ্কার মতো দেশে চাষবাসে ব্যবহৃত কীটনাশক রাখা হয় একটি নির্দিষ্ট গোডাউনে। তা বাড়িতে মজুত করা যায় না।  রাগ বা উত্তেজনার মধ্যে কোনওভাবেই কেউ যেন হাতের কাছে কীটনাশক না পান। 

  • কিন্তু শহরাঞ্চলে কীটনাশকের থেকেও ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা করতে হবে, একই প্রেসক্রিপশন নিয়ে যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একাধিক বার ঘুমের ওষুধ কেনা না যায়। যদি ঘুমের ওষুধ বিক্রির পরে দোকান তারিখ সহ স্ট্যাম্প মেরে দেয়, তাহলে সেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে তিনি আবার অন্য দোকানে গিয়ে কিনতে পারবেন না ঘুমের ওষুধ। 

  • নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে প্যারাসিটামল বিক্রিও। কারণ অনেক প্যারাসিটামল ট্যাবলেট একসঙ্গে খেয়ে নিলেও নির্ঘাত মৃত্যু। 

  • কিন্তু সবসময় তো ওষুধ বা কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে না, অন্য উপায়ও আছে। তা রুখতে প্রয়োজন পাশাপাশি থাকা মানুষের সচেতনতা। আপনি খেয়াল রাখুন - 
    - আপনার চেনা কোনও বৃদ্ধ মানুষ কি হঠাত করে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন?
    - হঠাৎ করেই দলিল করে সম্পত্তি ভাগ করে দিতে চাইছেন ?
    - নিজের প্রিয় সামগ্রী অন্যদের দিয়ে দিচ্ছেন ?
    - সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও কি হঠাৎ সরে গেছেন?
    - হঠাত করে কি আপনার পরিচিত কোনও বয়স্ক মানুষ বারবার আত্মহত্যা ও মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করছেন ?
    তবে সতর্ক থাকুন। তাঁর খোঁজ খবর নিন। দরকারে তাঁর পরিবারের অন্য মানুষ বা দূরে থাকা আত্মীয় স্বজনদের বিষয়টি জানান। 

  • ডা. সরখেলের মতে, অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে কোনও সুইসাইডের ঘটনার বারবার পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্প্রচার, রিকনস্ট্রাকশন দেখে অনেক আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ ওই পদ্ধতিতে আত্মহত্যা করতে চান। 

  • কেউ ব্যক্তিগতভাবে হতাশা বা একাকীত্ব অনুভব করলে কিংবা করোনাকালে ইনসিকিওরড অনুভব করলে কলকাতা পুলিশের প্রণাম উদ্যোগের সঙ্গে কিংবা বিধাননগর পুলিশের সাঁঝবাতি-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। নিজের প্রয়োজনের কথা জানাতে পারেন। সেই সঙ্গে কোনও এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

  • নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোনও পোষ্য রাখতে পারেন, তাহলে নিজে বাঁচার তাগিদ অনুভব করবেন। 

    ডা. সরখেল জানালেন, করোনাকালে অনেকেই হারিয়েছেন তাঁর স্বামী বা স্ত্রীকে। ছেলেমেয়েরাও হয়ত কাছে নেই। তখন একাকীত্ব ও জীবনের প্রতি অনাগ্রহটা চরমে ওঠে। এই সমস্যা নিয়ে বহু রোগী তিনি পেয়েছেন। এই সঙ্কট কাটাতে এই সময় আমাদেরকেই পাশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, এছাড়া উপায় নেই।