আশাবুল হোসেন, কলকাতা: রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাতে নতুন মোড়। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের বিরুদ্ধে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লার কাছে নালিশ বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে বিধানসভার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা, বিল আটকে রাখার অভিযোগ এনেছেন অধ্যক্ষ। তিনি রাজ্যে আট দফার ভোট নিয়েও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন।


‘বিধানসভার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন রাজ্যপাল। বিধানসভা রাজ্যপালের এক্তিয়ার নয়, অধ্যক্ষের এক্তিয়ার। কোনও বিল পাস করে পাঠানো হলেও অনুমতি মিলছে না। সই না করে বিল ফেরত পাঠাচ্ছেন রাজ্যপাল,’ স্পিকারদের নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে অভিযোগ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের। 


লোকসভার অধ্যক্ষের কাছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন বিধানসভার অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, ‘২০২০-তে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে আটজন বিধায়কের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২১-এ করোনা আক্রান্ত হয়ে দু’জন বিধায়কের মৃত্যু হয়েছে। আট দফার ভোটের জন্যই এমনটা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও কম দফায় ভোট চেয়েছিলেন, কিন্তু সে কথা শোনা হয়নি।’


রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগে বারবার সরব হয়েছেন রাজ্যপাল। দিল্লি সফরের পর তিনি এখন উত্তরবঙ্গে। দিল্লি যাত্রার আগেই ভোট পরবর্তী অশান্তি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিঁধে ফের চিঠি দেন রাজ্যপাল। এই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, ‘বাংলায় ভোট পরবর্তী হিংসা, রক্তপাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন থামছে না। নারী নির্যাতন, বিরোধীদের সম্পত্তি ধ্বংস হয়েই চলছে। অথচ, এই নিয়ে আপনি (মুখ্যমন্ত্রী) আশ্চর্যজনকভাবে নীরব এবং নিষ্ক্রিয়।’ রাজ্যপালের অভিযোগ, বারবার দৃষ্টি আকর্ষণের পরেও, মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় একদিনও এই ব্যাপারে আলোচনা করেননি।


অতীতে, ভাঙড়ে প্রাক্তন সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লার উপর হামলা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ নিয়ে মন্তব্য করায় তৎকালীন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সম্পর্কে সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ওনাকে নজরে রাখছি৷ বেশি কিছু কঠিন বললাম না৷ পরে বলব৷ আপাতত হলুদ কার্ড দেখালাম৷ এরপর লাল কার্ড৷’


অতীতে উত্তরাখণ্ড ও অরুণাচল প্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসন নিয়ে, আদালতে প্রশ্নের মুখে পড়েছিল রাজ্যপালদের ভূমিকা। অরুণাচল প্রদেশের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার যখন কাজ করছে, তার মধ্যে রাজ্যপাল হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। রাজনীতিতে ঘোড়া কেনাবেচা থেকে তাঁকে দূরে থাকতে হবে। রাজনীতিতে জড়ানো রাজ্যপালের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। কোনও রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ হলে সে বিষয়ে রাজ্যপালের নির্লিপ্ত থাকা উচিত।’


ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭, এগারো বছরে ৩৯ বার একের পর এক কংগ্রেস-বিরোধী রাজ্যে সরকার ভেঙে দিয়ে রাজ্যপালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে। ১৯৭৭-এ জনতা পার্টি দিল্লির ক্ষমতায় এসে দু’বছরের মধ্যে ১১ বার বিভিন্ন রাজ্যে একই কাজ করে। যে সরকারের শরিক ছিল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে বারবার রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত দেখা গিয়েছে। 


ন। নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনার পর গোপালকৃষ্ণ গাঁধী মন্তব্য করেছিলেন, ‘শিঁরদাঁড়ায় আতঙ্কের হিমেল স্রোত বয়ে গেছে।’ বিধানসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ হাসিম আব্দুল হালিম প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘রাজ্যপাল কি আদৌ এমন মন্তব্য করতে পারেন?’ বাম নেতা বিনয় কোঙার বলেছিলেন, ‘রাজ্যপাল তৃণমূলের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামুন।’


এখন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সাংবিধানিক এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্যপালকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তিনবার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। 


তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথ নেওয়ার দিন থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগে সরব রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। যদিও, সংঘাতের সূত্রপাতটা শুরু থেকেই। সেই ২০১৯ থেকেই। তারপর থেকে দিন যত গড়িয়েছে, রাজ্য ও রাজ্যপালের দ্বন্দ্ব তত বেড়েছে। কার্যত এমন কোনও ইস্যু নেই যাতে রাজ্যপাল-রাজ্য সরকার সংঘাত বাঁধেনি।


২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পদে বসানো হয় জগদীপ ধনকড়কে৷ রাজ্যপাল পদের মেয়াদ ৫ বছর। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, তার আগেই পদ থেকে রাজ্যপালকে সরানোর সংস্থানও রয়েছে। রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠানো হতে পারে কেরলের বর্তমান রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানকে। 


এ প্রসঙ্গে অনেকেরই প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ১৯৬৯ সালে বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার সময় থেকে রাজ্যপাল ধর্মবীরের সঙ্গে তাদের সংঘাত বেধেছিল। রাজ্য সরকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর দ্বারস্থ হয়ে ধর্মবীরকে সরানোর দাবি তোলে। ইন্দিরা সে দাবি মেনে নিয়েছিলেন। বাংলার নতুন রাজ্যপাল হয়ে আসেন শান্তিস্বরূপ ধবন। 


যদিও এবার রাজ্যপাল পদে ধনকড়ই থাকবেন, না কি আরিফ মহম্মদ খানকে কেরল থেকে বাংলায় আনা হবে, তা নির্ভর করছে মোদি সরকারের ওপর। এদিকে, ইস্যুতে কার্যত তৃণমূলের সুরেই রাজ্যপালের আচরণের বিরোধিতা করেছে বামেরা। যাদের দীর্ঘদিনের বক্তব্য, রাজ্যপাল পদটাই থাকা উচিত নয়। 


আটের দশকের শেষে সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, রাজ্যপাল নিয়োগ করার আগে কেন্দ্রীয় সরকার তথা রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলে নেবেন। যদিও এই সুপারিশ কংগ্রেস বা বিজেপি নেতৃত্বাধীন কোনও সরকারই কোনওদিন মানেনি।