লহৌর: ‘তব পাকিস্তান বানায়া থা, অব পাকিস্তান বচায়েঙ্গে...’


নির্বাচনী মরসুমে উত্তেজনার পারদ যখন চড়ছে, সাড়ে তিন বছর আগে প্রচার মঞ্চ থেকে এই পাকিস্তানকে (Pakistan Politics) পুনর্জীবন দিতে এমনই রব তুলেছিলেন ইমরান খান (Imran Khan)। ফাস্ট ফরোয়ার্ড সাড়ে তিন বছর— আজ তাঁর হাত থেকেই নিস্তার পেতে চাইছে দেশের একটি বড় অংশ। শেষ মুহূর্তে ইনসুইং ইয়র্কার খেলে ইমরান যদিও তিন মাসের সময় বার করে নিয়েছেন নিজের জন্য। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাঁকে বিমুক্ত (Imran Khan De-notified as Pakistan PM) করে দিয়েছে দেশের ক্যাবিনেট ডিভিশন। অর্থাৎ বর্তমানে তিনি শুধুই দেশের প্রধানমন্ত্রী নন তিনি। আগামী ১৫ দিন পদে থাকলেও, তা নামসর্বস্ব। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না তিনি। আর তাতেই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারা পূর্বসূরি  প্রধানমন্ত্রীদের দলেই নাম লেখালেন ইমরান।


আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নন ইমরান খান


১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত নয় নয় করে ২২ বার প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে পাকিস্তান। ২২তম বার প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান। কিন্তু কোনও বারই কেউ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। মাঝপথে খুন হতে হয়েছে কাউকে, কারও গলায় পড়েছে ফাঁসির দড়ি, দুর্নীতি, অব্যস্থার জেরে পদ ছাড়ার উদাহরণও রয়েছে ভূরি ভূরি। অর্থনৈতিক সঙ্কট, মুদ্রাস্ফীতির জেরে ইমরানের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ জমা হচ্ছিল বেশ কয়েক মাস ধরে। এক এক করে বিশ্বস্তরা ছেড়ে যাচ্ছিলেন তাঁকে। তার পর জমা পড়ে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব। রবিবার ছিল ভোটাভুটির দিন। কৌশলে তা ভোটাভুটি ভেস্তে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের রাস্তা যদিও বার করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই কৌশল সংবিধানবিরোধী বলে ইতিমধ্যেই দাবি উঠতে শুরু করেছে। তাই তিন মাস পর ভোট হলেও, পাকিস্তানের মসনদে ইমরানের প্রত্যাবর্তন অনিশ্চিত।


আর তাতেই পূর্বসূরিদের সঙ্গে তুলনা চলে আসছে ইমরানের। যে সম্মানের সঙ্গে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি, সাধুবাদ পেয়েছিলেন, রাজনীতিতে সেই উচ্চতা ছোঁয়া হল না তাঁর। মেয়াদপূর্ণের স্বপ্নও থেকে গেল অধরা। ভবিতব্য পাল্টানো তো হলই না, উল্টে পাক মসনদের ৭৫ বছরের ইতিহাসে ‘অসফল’ প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় নাম জুড়ে গেল তাঁর।


পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি যাঁরা


লিয়াকৎ আলি খান: পাক মসনদের এই অধরা যাত্রার সূচনা ঘটে লিয়াকৎ আলি খানের হাত ধরেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু মসনদে মাত্র চার বছর দু’মাসই ছিলেন। মুসলিম লিগের হয়ে লহৌরে প্রচারের সময় রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হন তিনি।


স্যর খোয়াজা নিজামউদ্দিন: দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসবে ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর দায়িত্বগ্রহণ করেন। কিন্তু দু’বছরেরও কম সময় মসনদে টেকেন তিনি। তাঁর আমলে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। তার জেরে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ পদত্যাগের নির্দেশ দেন। অমান্য করায় ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁকে অপসারণ করা হয়।


মহম্মদ আলি বোগরা:  ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল দায়িত্বগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালের ১২ অগস্ট তাঁকে অপসারণ করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা। আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে মতানৈক্য ঘিরে বিরোধ বাধে। দেশের অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান তিনি।
চৌধরি মহম্মদ আলি: ১৯৫৫ সালের ১২ অগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর হাতেই পাকিস্তানের সংবিধানের নীল নকশার সূচনা। দলের সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি। মাত্র এক বছর এক মাস ক্ষমতায় ছিলেন।


হুসেন শাহিদ সোহরাবর্দি: ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইস্কান্দর মির্জার সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয় ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর।


ইব্রাহিম ইসমাইল চান্দ্রিগড়: দু’মাসেরও কম সময় মসনদে ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।৫৫ দিনের মাথায় অ্যাসেম্বলিতে আস্থাভোটে হেরে যান। তার জেরে পদত্যাগ করতে হয়।


ফিরোজ খান নুন: ইস্কান্দর মির্জা নিজে তাঁকে মনোনীত করেছিলেন। ১৯৫৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর শপথ নেন। কিন্তু দু’জনের সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে তলানিতে এসে ঠেকে।১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তাঁকে অপসারণ করা হয়। তাঁর পতনের পরই জেনারেল আয়ুব খান চিফ মার্শাল ল’র প্রশাসক নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত হন আয়ুব। পরব্রতী কালে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং প্রেসিডেন্টের দফতরে মিলিয়ে দিয়ে সেনা অভ্যুত্থান ঘটান আয়ুব। তবে বার বার প্রধানমন্ত্রী বদলের চেয়ে আয়ুবের হাতে কিছুটা হলেও স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছিল পাকিস্তান।


নুরুল আমিন: মাত্র ১৩ দিন মসনদে ছিলেন। ১৩ বছরের মার্শাল ল’ অতিক্রান্ত হওয়ার পর স্বৈরাচারী ইহাইয়া খানের প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রী হন আমিন। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটেছে। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ১৩ দিনের মাথায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁকে।


জুলফিকর আলি ভুট্টো: ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে ফের নির্বাচনে জয়ী হন। কিন্তু স্বৈরাচারী সেনা প্রধান জেনারেল মহম্মদ জিয়া উল-হক তাঁকে বন্দি করেন। ১৯৭৯ সালে ফাঁসি হয় ভুট্টোর।


মহম্মদ খান জুনেজো: ১৯৮৫ সালের ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হন। সেই সময় দেশে সেনা কর্তৃত্ব চলছে। ১৯৮৮ সালের ২৯ মে তাঁর সরকারে অবলুপ্তি ঘটে। জিয়া উলের সঙ্গে মতানৈক্যের জেরেই মসনদ খোয়াতে হয় তাঁকে।


বেনজির ভুট্টো: দেশের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেনজির। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। তাঁর হাত ধরেই সেনা শাসনের অবসান ঘটে পাকিস্তানে।১৯৮৮ সালের ৯ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বেনজির। কিন্তু তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এতই বৃদ্ধি পায় যে ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট তাঁকে ইমপিচ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইশাক খান।


নওয়াজ শরিফ: প্রথম বার ১৯৯০ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শরিফ। তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁর সরকার ভেঙে যায়, ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল। সে বছর জুলাই মাসে ইস্তফা দেন।


বেনজির ভুট্টো: দ্বিতীয় বার ১৯৯৩ সালের ১৯ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন বেনজির। প্রথম দফার থেকে কিছু দিন বেশি টিকলেও, ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর দুর্নীতির অভিযোগেই তাঁর সরকার ভেঙে দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফারুখ লেঘরি।


নওয়াজ শরিফ: ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে ক্ষমতায় ফেরেন। জেনারেল পারভেজ মুশারফকে তিনিই তুলে আনেন। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে ভাঁটা পড়ে। ১৯৯৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সেনা অভ্যুত্থান ঘটলে শরিফ সরকার ভেঙে যায়। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন মুশারফ।


মীর জাফরউল্লা খান জামালি: দীর্ঘ দিন প্রধানমন্ত্রী পদ খালি পড়ে থাকার পর ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর নিযুক্ত হন জামালি। কিন্তু প্রশাসকের চেয়ে মুশারফের অনুগত হিসেবেই কটাক্ষ শুনতে হত তাঁকে। মুশারফের সঙ্গে মতানৈক্যেরই খেসারত দিতে হয়। ২০০৪ সালের ২৬ জুন তাঁকে অপসরাণ করেন মুশারফ।


চৌধরি সুজাত হুসেন: সংসদীয় নির্বাচনে জিতে ২০০৪ সালের ৩০ জুন ক্ষমতায় আসেন। সে বছর ২৭ আগস্টই শওকত আজিজকে আসন ছেড়ে দেন।


শওকত আজিজ: ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পদে ছিলেন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন। সংসদীয় মেয়াদ শেষ হতে আসন ছেড়ে দেন।


ইউসুফ রজা গিলানি: ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২০১২ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ত্রিশঙ্কু অ্যাসেম্বলিতে তাঁকে জোট সরকারের মাথা করা হয়। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হন। শেষমেশ তাঁর পদ বাতিল করে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্তও হন।


রজা পারভেজ আশরফ: ২০১২ সালের ২২ জুন থেকে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাঁকে মনোনীত করে। কিন্তু বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন।


নওয়াজ শরিফ: ২০১৩ সালের ৫ জুন থেকে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু পানামা পেপারস দুর্নীতি মামলায় তাঁকে ইমপিচ করে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। আজীবন নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপরও নিষেধাজ্ঞা চাপে। ২০১৮ সালে হিসেব বহির্ভূত আয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন শরিফ। কিন্তু চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়ে আর দেশে ফেরেননি।


শাহিদ খাকান আব্বাসি: শরিফের বাকি পড়ে থাকা মেয়াদ পূর্ণ করতে ২০১৭ সালের ১ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আব্বাসি। দেশের ২১তম প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। নতুন করে নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৩১ মে অ্যাসেম্বলি ভেঙে যায়।


ইমরান খান: ২০১৮ সালের ১৮ অগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান। ২০২৩ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। রবিবার আস্থাভোট ভেস্তে দিয়ে তিনমাস পর নতুন করে নির্বাচন করানোর কৌশল তাঁরই রচনা। রাতে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে বিমুক্ত করে দেয় ক্যাবিনেট ডিভিশন। কিন্তু কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন নাকি চিফ এগজিকিউটিভ হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন, তা নির্ভর করছে প্রেসিডেন্টের হাতে।


আরও পড়ুন: Pakistan Assembly Dissolved: পাকিস্তানের সংসদ ভেঙে দিলেন প্রেসিডেন্ট, ৯০ দিনের মধ্যে ভোট