কলকাতা: আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন স্তরে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নারীরাও যে এগিয়ে আসতে পারেন, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র না থেকে নিজের নিজের স্বপ্ন ছোঁয়ার বার্তা দিতে পারেন, সেই ভাবনার উদযাপনই আন্তর্জাতিক নারী দিবস (International Women's Day)। এ আসলে নারীর সমানাধিকারের লড়াইয়ের উদযাপন। ৮ মার্চ সেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রেক্ষাপটে অন্ধকার থেকে আলোয় আসা এক নারীর কাহিনি শুনে নেওয়া যাক যিনি নিজের অক্ষমতাকেই আজ শক্তিতে পরিণত করেছেন, নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও হাজার হাজার প্রতিবন্ধীর মনে আশা জোগাচ্ছেন তিনি। প্রীতি শ্রীনিবাসন। ১৮ বছর বয়সে পঙ্গু হয়েও জীবনের মানে খুঁজে নিয়েছিলেন প্রীতি, বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজের মত করে, নিজের শর্তে। জীবনের সমস্ত ধরনের চ্যালেঞ্জ হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন প্রীতি। একসময় ক্রিকেটার ছিলেন, ক্রিকেটকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রীতি (Preethi Srinivasan) আর আজ নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে 'সোলস ফ্রি' (Souls Free) নামে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে এমনই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।


চেন্নাইতে জন্ম হয়েছে প্রীতি শ্রীনিবাসনের (Preethi Srinivasan), বড় হয়েছেন তিনটি আলাদা আলাদা দেশে বড় হয়েছেন তিনি। মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর সাঁতার শেখা, এমনকী তিনি ধীরে ধীরে একজন জাতীয় স্তরের সাঁতারু হয়ে ওঠেন। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের পরে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে চার বছর বয়সেই শুরু করেন ক্রিকেট খেলা। ৮ বছর বয়সে তিনি তখন তামিলনাড়ুর স্টেট টিমে খেলছেন, আর ধীরে ধীরে তামিলনাড়ুর অনূর্ধ্ব ১৯ স্টেট টিমের অধিনায়কও হয়ে ওঠেন প্রীতি।


সবই ঠিক চলছিল, অনূর্ধ্ব ১৯ দল থেকে জাতীয় দলে যোগ দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল প্রীতির। কিন্তু হঠাৎ করেই বদলে গেল জীবনের মোড়। ১৮ বছর বয়স তখন, পণ্ডিচেরিতে একটা সমুদ্রের ধারে বন্ধুদের সঙ্গে ঝেলতে খেলতে পড়ে যান প্রীতি আর তাতেই স্পাইনাল কর্ডে চোট লাগে। তারপর ধীরে ধীরে পঙ্গুত্ব গ্রাস করে তাঁকে। গলার নিচ থেকে সমস্ত অঙ্গ অসাড় হয়ে যায় প্রীতির। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় একেবারে। কিন্তু আশা ছাড়েননি প্রীতি (Preethi Srinivasan)। জীবনবিমুখ হননি। সব স্বপ্ন হারিয়েও ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠেছেন তাঁর 'সোল ফ্রি'র হাত ধরে। ২০১৩ সালে তিনি তৈরি করেন 'সোল ফ্রি' নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট যেখানে তারই মত স্পাইনাল কর্ডে আঘাত পেয়েছে এমন মানুষদের চিকিৎসা করা, তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্যের মাধ্যমে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজ হয়।


শুধু এখানেই শেষ নয়, আরও কঠিন পরীক্ষা নিয়েছে জীবন। ২০০৭ সালে তিনি যখন সদ্য জীবনের একটা অন্য মানে খুঁজে নিতে চাইছেন, তাঁর বাবার মৃত্যু হয় হৃদরোগে আর তাঁর কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর মাও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তুলোর চাদরে মোড়া জীবন থেকে একেবারে কাঁটার রাস্তায় পড়ে যান প্রীতি। তাঁর নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও ঠাকুমাকে সঙ্গে করে চলতে হয়েছে তাঁকে। পরেরদিন কী খাবেন, কীভাবে চলবে তাঁর ঠিক ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে প্রীতি (Preethi Srinivasan) বলেছেন, 'আমার মন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনের প্রথম ১৮ বছর আমি কোনও সমস্যাই বুঝিনি কখনও। বাড়িতে প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি, অনেক আদরে থেকেছি। আমেরিকায় সেরা ২ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে পড়াশোনা করেছি, ক্রিকেট খেলেছি, জীবনে সাফল্যের পথে ক্রমে ক্রমে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আর সেই দুর্ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সবেতে ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠা একটা মেয়ে আমি নিজে নিজে খেতে পারতাম না, স্নান করতে পারতাম না, বিছানা থেকে নিজে উঠতেও পারতাম না।'


তবু হাল ছাড়েননি প্রীতি। বন্ধুদের পরামর্শে মেডিক্যাল সোশিওলজিতে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি, পরে সাইকোলজিতে এমএসসি করেন তিনি। তিনি খবর পান দুটি প্যারাপ্লেজিক মেয়েকে তাঁদের পরিবার বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। এই ঘটনা স্তম্ভিত করে দেয় প্রীতিকে। শুরু হয় 'সোল ফ্রি' সংস্থা তৈরির ভাবনা। ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শিবিরের মাধ্যমে এই সংস্থায় আজও বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকে মানসিক ও আর্থ সামাজিক দিক থেকে সুস্থ-সবল করার চেষ্টা করা হয়, যাতে তাঁরা কিছু উপার্জনে সক্ষম হন সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রতিবন্ধী মানুষদের। বর্তমানে মাদ্রাজ আইআইটি থেকে পিএইচডি করছেন প্রীতি শ্রীনিবাসন। তাঁর জীবন আজ শত শত মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার অপর নাম, হাল না ছেড়ে হেরে না যাওয়ার নাম।  


আরও পড়ুন: IPS Success Story: মা করতেন রান্নার কাজ, ডিম বিক্রির টাকায় চলত সংসার- লড়াই করেই সাফল্যের শীর্ষে সাফিন