বিটন চক্রবর্তী,পূর্ব মেদিনীপুর: শিল্পীর (Artist) আবার ধর্ম, জাত, লিঙ্গ, বর্ণ হয় নাকি? তাঁর একমাত্র দেওয়া-নেওয়া শুধু শিল্পের (art) সঙ্গে। অবুঝ বয়স থেকে এমনই একটা কিছু অনুভব করতেন নুর মহম্মদ চৌধুরি। তখন অবশ্য স্রেফ খেলাচ্ছলেই মূর্তি (idol) গড়তেন নুর। কবে যেন সেই খেলা তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল, এখন আর মনে পড়ে না। তবে আকাশে-বাতাসে শরতের (spring) ডাক শুনলেই প্রবীণ শিল্পী টের পান, এবার তাঁর চরম ব্যস্ততার সময় এসে গিয়েছে। মায়ের মূর্তি গড়তে হবে যে!


অনন্য সে 'নুর'...
হলদিয়া পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের আন্দুলিয়া এলাকার নুর মহম্মদ চৌধুরি এখন মৃৎশিল্পী হিসেবে রীতিমতো জনপ্রিয়। যদিও মূর্তি গড়ার কাজে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল একেবারে শৈশবেই। বয়স মেরেকেটে ছ'বছর। খেলার ছলে কাদা মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ার চেষ্টা করতেন খুদে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে গ্রামের পুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জন মাঝেমধ্যেই নজরে পড়ত শিশুর। সকলের অগোচরে প্রতিমার খড়ের তৈরি ভুর বাড়ি নিয়ে এসে তাতে কাদের প্রলেপ দিয়ে ফের ঠাকুর গড়ার চেষ্টা করত সে। একেবারে নেশা লেগে যেত। স্কুলের লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিমা গড়ার দিকেও সমান ভাবে ঝুঁকে পড়ছিল সে। নুরের কাজ শেখার জেদ দেখে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন পাশের গ্রামের রাধাকৃষ্ণ সামন্ত। ভালবাসার কাজ নিয়ে মগ্ন থাকতেন মৃৎশিল্পীও। কিন্তু তাঁর গল্পের সবটা এত মসৃণ ছিল না।
   দেব-দেবীর মূর্তি গড়তেন বলে নানা দিক থেকে নানা রকম বাধা পেয়েছেন নুর। একসময়ে একঘরে ঘরে দেওয়া হয়েছিল, জানালেন শিল্পী। এমনকী, মা নুরজাহান বিবির মৃত্যুর পরও তিনি কাউকে পাশে পাননি। বাধ্য হয়ে নিজের বসতভিটের পাশেই সমাধিস্থ করেন মাকে। কিন্তু হাল ছাড়েননি, ভালবাসার কাজও না। যত বাধা এসেছে, তত জেদ বেড়েছে তাঁর। কথা নয়, বরং নিজের কাজে আরও বেশি মন দিয়েছেন নুর। তাঁর হাতের জাদুতে অনন্য হয়ে ফুটে উঠেছে দেব-দেবীদের মূর্তি। অবশেষে বদলেছে সময়। এখন তিনি রীতিমতো জনপ্রিয়, তাঁর হাতের মাতৃমূর্তির চাহিদাও তুঙ্গে।


জনপ্রিয়তা...
সারা বছর ধরেই দেবদেবীর মূর্তি গড়েন নুর মহম্মদ চৌধুরী। কিন্তু দুর্গাপুজো মানে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাবেন না, একথা জানেন প্রবীণ শিল্পী। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মূর্তির বরাত আসে তাঁর কাছে। স্মৃতি হাতড়ে নুর জানালেন, একসময়ে সুতাহাটার  চৈতন্যপুরের একটি পুজো কমিটির প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন ৩৫০ টাকা দিয়ে। আজ তাদেরই প্রতিমার বাজেট ৩৫০০০ টাকা। অর্থের অঙ্ক বেড়েছে, সঙ্গে আরও হয়তো কিছু বদলেছে। বদলাননি শুধু প্রতিমা শিল্পী। আজও সেই নূর মহম্মদের থেকেই মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তিকে নিয়ে যান ওই পুজো কমিটির সদস্যরা। শিল্পীর এমন সাফল্যে তাঁর পাড়াপড়শিদের মধ্যেও বদলের মেজাজ স্পষ্ট। একদিন যাঁরা তাঁকে নিয়ে  তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, আজ তাঁরাও গর্ব অনুভব করেন। শিল্পী জানালেন, ভিন ধমের ইষ্টদেবতার মূর্তি তৈরি করেন দেখে কখনও নিজের ধর্মের অবমাননা করেননি। তবে তাঁর কথায়, 'অন্যের ধর্মকে সম্মান দিলেই নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায়।' 
সেই শ্রদ্ধাই নিজের সংসার থেকে আশপাশের মানুষজন, সকলের কাছ থেকে ফিরে পাচ্ছেন ৫৭ বছরের মৃৎশিল্পী। 


আরও পড়ুন:অতীতেও হামলা ছাত্রনেতা আনিস খানের ভাইয়ের উপর, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ পরিবারের