কলকাতার অভিভাবক মা-কালী


কালীক্ষেত্র কালীঘাট। উত্তরে দক্ষিণেশ্বর আর দক্ষিণে বহুলা বা বেহালা। মাঝে ধনুকের মতো বাঁকা অংশ কলকাতা। পীঠনির্নয় তন্ত্র অনুসারে কালীক্ষেত্র কলকাতার মাহাত্ম্য বারাণসীর সমতুল। সেই কলকাতার অভিভাবকরূপে কালীঘাটে বিরাজ করছেন মা দক্ষিণাকালী। সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম।  


কালীক্ষেত্রের এত মহিমা কেন? 


বলা হয়, বেহালা থেকে দুই যোজন ব্যাপী কালীক্ষেত্রের ৩ কোণায় অবস্থান করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তাঁর মাঝেই মহাকালীর অবস্থান। এখানে ভৈরবী, বগলা, বিদ্যা, মাতঙ্গী, কমলা, ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী ও চণ্ডী সর্বদা বিরাজ করছেন। তাই এই জায়গা কাশী বা  বারাণসীর মতোই মহা পূণ্যভূমি। মন্দিরের উপরে রয়েছে ৩ টি কলস , ১ টি ত্রিশূল ও ১ টি ত্রিকোণা ধাতব পতাকা যাতে 'ॐ' লেখা রয়েছে। এটি তৈরি করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং তাতে খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। 


 


কালীঘাট কেন সতীপীঠ ? 

দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার জন্য শিবের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন সতী। শিব বলেছিলেন, বিনা আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতী মহাদেবকে বিয়ে করায় ক্ষুব্ধ ছিলেন দক্ষ। আর সেজন্য মহাদেব ও সতী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী উপস্থিত হন। তবে আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় যথাযোগ্য সম্মান পাননি সতী। মহাদেবকেও অপমান করেন দক্ষ। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন সতী। ক্রোধে, শোকে জ্বলে ওঠেন শিব।  শেষমেষ বিষ্ণুর বুদ্ধিতে রক্ষা পায় জগত। সুদর্শন চক্রে সতীর দেহকে একান্ন টুকরো করেন নারায়ণ। যে সব জায়গায় সেই দেহখণ্ডগুলি পড়েছিল, সেগুলিই হল এক-একটি পীঠ। তার মধ্যে একটি পিঠ কালীঘাটও। কলকাতার কালীপীঠ কালীঘাটে সতীর ডান পায়ের আঙ্গুল পড়েছিল বলে কথিত। 


মা কালীর আবির্ভাব 


কালীঘাটের মন্দির কে তৈরি করলেন, কার আমলে ছড়িয়ে পড়ল মায়ের মাহাত্ম্য ? এই প্রশ্ন ঘিরে নানা বিশ্বাস, নানা ইতিহাস, নানা কিংবদন্তি।  তার মধ্যে একটি প্রচলিত কাহিনী হল, আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে এক মাতৃসাধক কালীক্ষেত্রে দেবীর কঠোর তপস্যা করছিলেন। আত্মারাম একদিন রাতে দেবীর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তাঁকে বলা হয়, তিনি যে বেদীতে বসে তপস্যা করছিলেন, সেটি ব্রহ্ম বেদী। অর্থাৎ একসময় ব্রহ্মা ওই বেদীতে বসে তপস্যা করেছিলেন। তাঁকে আরও নির্দেশ দেওয়া হয়, নীলগিরি পর্বতে ব্রহ্মানন্দ গিরি নামে এক সাধক আছেন, তাঁর কাছে যে শিলাস্তম্ভ আছে, সেটিকে ব্রহ্মবেদীতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কালীয় কুণ্ডের ভীতরেই যে সতীর পায়ের চার আঙুল রয়েছে, তাও জানায় ওই দৈব কণ্ঠ। পরে আত্মারাম নীলগিরি পর্বতে গিয়ে ব্রহ্মানন্দ গিরিকে খুঁজে পান। এবং শোনা যায়, কোনও এক দৈবী শক্তি বলে ১২ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া ওই শিলা দিয়ে আদিগঙ্গার তীরে কালীক্ষেত্রে এসে ওঠেন। কথিত আছে, স্বয়ং বিশ্বকর্মা সেই সময় উপস্থিত হয়ে ওই শিলাকে ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করেন এবং মাতৃরূপ দেন। ত্রিনয়না মূর্তি চতুর্ভূজ উপরের বাম হাতে খড়গ, নীচের বাম হাতে নরমুণ্ড। ডানদিকের উপরের হাতে বর ও নিচের হাতে অভয় মুদ্রা। তখন কিন্তু সতীর চার আঙুলের সন্ধান পাননি কেউই। পরবর্তীতে আত্মারামই জ্যোতি দ্বারা সঙ্কেত পেয়ে কালীয় হ্রদে খুঁজে পান সতীর প্রস্তুরীভূত ডান পায়ের চার আঙুল। তখন তা জল থেকে তুলে এনে মাকালীর বেদীর নিচে স্থাপন করা হয়। সেই দিনটা ছিল স্নানযাত্রা। আজও সেই বিশ্বাস থেকে প্রতিবছর ওই দিন সকাল থেকে মন্দির বন্ধ থাকে। বয়ঃজ্যেষ্ঠ সেবায়েতরা চোখে কাপড় বেঁধে সতীর সেই চরণাঙ্গুলি বের করে তাঁকে যথাবিহিত স্নান ও পুজো করেন।    


কালীঘাটে ভিড় হয় কবে কবে ?


সাধারণ ভাবে সারা বছরই শনিবার ও মঙ্গলবার মন্দিরে ভক্তদের ভিড় বেশি থাকে। এছাড়া পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ায় হালখাতা পুজোর বড় ভিড় হয়। বিপত্তারিনী পুজোতেও ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। তবে কালীঘাটের মূল পুজো আটটি। রক্ষাকালী, স্নানযাত্রা, জন্মাষ্টমী, মনসাপুজো, চড়ক, গাজন, রামনবমী, আর দীপাবলী। কালীঘাট মন্দিরে দুর্গাপুজোও করা হয়।   


আরও পড়ুন : পড়েছিল সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র, এখানে পাপস্খালন করেছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র, পড়ুন মরুতীর্থ হিংলাজ কথা