কলকাতা: নামের সঙ্গে শূন্য জুড়ে থাকলেও, মহাশূন্যের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে গভীর রহস্য (Space Science)। সৃষ্টিতত্ত্বের সন্ধানে বেরিয়ে এক এক করে তার জট খুলতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা (Science News)। তাতে যত সময় যাচ্ছে, ততই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছেন সকলে। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আরও একবার সকলকে চমকে দিল। মহাশূন্যের কনিষ্ঠতম নক্ষত্র ‘ফোমালহট’কে ঘিরে থাকা একাধিক বলয়ের তাক লাগানো ছবি সামনে আনল তারা। মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষ, গ্রহাণু জমেই ওই বলয়গুলি তৈরি হয়েছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। তবে এর গঠন অত্যন্ত জটিল বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
নাসা-র জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, ‘ফোমালহট’কে (Fomalhaut) ঘিরে থাকা ওই ধুলোর বলয়ের ছবি তুলেছে। আমাদের সৌরজগতের বাইরে আবিষ্কৃত গ্রহাণু বলয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ‘ফোমালহট’কে ঘিরে থাকা ত্রিস্তরীয় ওই উষ্ণ এবং উজ্জ্বল বলয়টি ফ্রেমবন্দি করে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। সেটি ২৩ ডিগ্রি কোণে হেলে রয়েছে। এর মধ্যে একটি বলয় আবিষ্কৃত হয় ১৯৮৩ সালে। জেমস ওয়েব আরও দু’টি বলয় সংযুক্ত করল। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বলয়টি অত্যন্ত উজ্জ্বল। অন্যটি সরু। ‘ফোমালহট’ থেকে মহাশূন্যে প্রায় ২৩০০ কোটি কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই তিন বলয়, যা সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যেকার দূরত্বের চেয়ে ১৫০ গুণ বেশি। আমাদের সৌরজগতে যে ‘কুইপার বেল্ট’ রয়েছে, তার চেয়ে বাইরের দিকের বলয়টি প্রায় দ্বিগুণ পুরু।
ওই ত্রিস্তরীয় ওই বলয়ের একেবারে মধ্যিখানে রয়েছে মহাশূন্যের কনিষ্ঠতম নক্ষত্র ‘ফোমালহট’ (James Webb Space Telescope)। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে রতের আকাশে খালিচোখে দেখতে পাওয়া যায় ওই উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে। সেটি নক্ষত্রপুঞ্জ ‘পিসিস অস্ট্রিনাসে’র অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘ফোমালহট’কে ঘিরে থাকা ত্রিস্তরীয় বলয়গুলি আসলে মহজাগতিক ধ্বংসাবশেষ। দুই গ্রহ বা বৃহদাকার কিছুর মধ্যে সংঘর্ষ থেকে উৎপত্তি। গ্রহাণু এবং ধূমকেতুর সমগোত্রীয়, যাকে ‘ধ্বংসাবশেষ চাকতি’ বলে উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরা। গ্রহমণ্ডল ঠিক কেমন হওয়া উচিত, ‘ফোমালহট’ এবং তাকে ঘিরে থাকা বলয় দেখে আঁচ করা সম্ভব বলে মত বিজ্ঞানীদের।
আরও পড়ুন: Solar Storm: ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেই সৌরঝড়ের প্রভাব! বন্ধ হতে পারে ফোন, বিমান পরিষেবা, বড় আশঙ্কা
৮ মে ‘নেচার অ্যাস্ট্রোনমি’-তে প্রকাশিত রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘ফোমালহট’কে ঘিরে থাকা এই ত্রিস্তরীয় বলয়কে ধরে রেখেছে চোখে না পড়া কিছু গ্রহের মহাকর্ষীয় শক্তি, যেভাবে আমাদের সৌরজগতে বৃহস্পতি গ্রহাণু বলয়কে ধরে রেখেছে, নেপচুন ধরে রেখেছে কুইপার বেল্টের ভিতরের অংশকে। ছবিতে ধুলোর মেঘও চোখে পড়েছে, তা দুই বরফাবৃত প্রোটোপ্ল্যানেটরি বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়েছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। একেবারে গোড়ায় তা বোঝা যায়নি বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
পৃথিবী থেকে ‘ফোমালহট’-এর দূরত্ব ২৫ আলোকবর্ষ। সদা পরিবর্তনশীল মহাজগতের সর্বকনিষ্ঠ নক্ষত্র সেটি। আমাদের সৌরজতের বাইরে পাওয়া গিয়েছিল যে প্রথম গ্রহ, সেটি ‘ফোমালহট’কে কেন্দ্র করে ঘুরছে বলে প্রথমে ধারণা জন্মেছিল। যদিও সেই গ্রহ ‘ডেগন’-এর অস্তিত্ব নিয়েও ধন্দ রয়েছে। নয়া আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের ধারণা, ‘ডেগন’ আসলে ধুলোর মেঘ ছাড়া কিছু নয়। তবে ‘ডেগন’-এর অস্তিত্ব না থাকলেও, ‘ফোমালহট’কে ঘিরেও অন্য একাধিক গ্রহ ঘুরছে বলে সন্দেহ বিজ্ঞানীদের। তবে এখনও পর্যন্ত তা চোখে পড়েনি। কিন্তু ‘ফোমালহট’কে ঘিরে যে ভাবে কাত হয়ে রয়েছে বলয়টি, তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রহ ধ্বংসাবশেষগুলিকে আলোড়িত করছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
নক্ষত্রকে ঘিরে থাকা এমন প্রোটোপ্ল্যানেটরি চাকতি সম্পর্কে প্রথম ধারণা জন্মায় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইম্যানুয়েল ক্যান্ট এবং পিয়ের-সিমোন লাপ্লেস এই তত্ত্ব তুলে ধরেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, ঘূর্ণায়মান গ্যাসের মেঘ ভেঙেই সূর্য এবং গ্রহগুলির উৎপত্তি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে পরে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। ‘ধ্বংসাবশেষ চাকতি’র উৎপত্তি পরবর্তীতে, গ্রহের জন্ম, গ্যাসের বিচ্ছুরণ থেকে। গ্রহাণুর মতো মহাজাগতিক বস্তুর পারস্পরিক সংঘর্ষে ধুলোর মেঘ এবং অন্য ধ্বংসাবশেষ জমে। তাই আমাদের সৌরজগতের বাইরেও এমন গ্রহমণ্ডল থাকার সম্ভাবনা প্রবল, যেখানে পৃথিবীর আয়তনের গ্রহও রয়েছে, রয়েছে গ্রহাণুও।