নয়াদিল্লি: ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে, কিছু করার থাকবে না বলে বারং বার সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তার পরও যতটা উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল, তা চোখে পড়েনি। এবার উদাসীনতার ফল মিলল হাতেনাতে। একেবারে হিমবাহ শূন্য হয়ে পড়ল গোটা একটি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সবক'টি হিমবাহ হারাল দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলা। আধুনিক যুগে আমেরিকা মহাদেশের অন্তর্গত প্রথম হিমবাহশূন্য দেশ হল তারা। এর জন্য মনুষ্যঘটিত জালবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। তিন দশক আগে হিমবাহ হারিয়েছিল ইউরোপের স্লোভেনিয়াও। এবার ভেনিজুয়েলার একই পরিণতি হল। (Venezuela Loses All Glaciers)
মে থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষা চলে ভেনিজুয়েলায়, যা শীতকাল হিসেবে গন্য হয়। বছরের বাকি চার মাস গন্য হয় গ্রীষ্ম হিসেবে। তার পরেও গত এক শতকে একটি একটি করে অবশিষ্ট ছ'টি হিমবাহ হারায় ভেনিজুয়েলা। ২০১১ সাল পর্যন্ত এক এক করে গলে গিয়ে পাঁচটি হিমবাহের অস্তিত্ব মুছে যায় সেখানে। অবশিষ্ট ছিল Humboldt হিমবাহটি। নাটকীয় ভাবে সেটিরও সঙ্কোচন ঘটেছে বলে এবছর মার্চ মাসেই জানান সেদেশের বিজ্ঞানীরা। এবার সেটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। (Humboldt Glacier)
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোপারনিকাস নজরদারি প্রকল্পের আওতায় কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা বেশ কিছু ছবি সামনে আসে, তাতে দেখা যায়, Humboldt হিমবাহের মাত্র ২ হেক্টরই অবশিষ্ট রয়েছে, যা ৫ একরেরও কম। অথচ কিছু বছর আগে পর্যন্ত Humboldt হিমবাহটির আয়তন ছিল ৪৫০ হেক্টর, অর্থাৎ ১১০০ একর। অন্তত ২৫ একর জুড়ে বিস্তার হলে, তবেই কোনও তুষারক্ষেত্র হিমবাহের তকমা পায়, তার কম হলে হিমবাহ বলা চলে না। সেই নিরিখে হিমবাহ শূন্য হল ভেনিজুয়েলা।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্যাটেলাইটের তোলা ছবি।
Humboldt হিমবাহটি La Corona অর্থাৎ রাজমুকুট নামেও পরিচিত। ভেনিজুয়েলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, Merida Cordillera-র উপর বিরাজ করছিল। সেটিরও সঙ্কোচন ঘটছে বলে আগে থাকতেই সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এমনকি এই মুহূর্তে হিমবাহটির ২ হেক্টরও আয়তন নয় বলে জানা গিয়েছে। শতকের পর শতক ধরে বরফ জমা হয়েই হিমবাহ তৈরি হয়। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি থাকলে এবং শীতকালীন তুষারপাত তার অস্তিত্ব বজায় থাকে বলে মত বিজ্ঞানীদের। শীতকালে যে পরিমাণ বরফ জমা হয়, গ্রীষ্মকালে তার ক্ষয় না হওয়াই দস্তুর হিমবাহের ক্ষেত্রে। তবেই হিমবাহ টিকে থাকে এবং আড়ে-বহরে বাড়তে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ভেনিজুয়েলায় তাপমাত্রার যে ওঠাপড়া চোখে পড়েছে, তাতে Humboldt হিমবাহটির টিকে থাকার কোনও সুযোগই ছিল না বলে মত University of the Andes-এর গবেষক, জ্যোতির্পদার্থবিদ আলেহান্দ্রা মেলফোর।
আরও একদশক অন্তত Humboldt হিমবাহটি টিকে থাকবে বলে এর আগে ভবিষ্য়দ্বাণী শোনা গিয়েছিল। তার আগে ঠিক কী কারণে গলে গেল সেটি? এর নেপথ্যে একাধিক কারণ উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এর জন্য মনুষ্যঘটিত কারণই দায়ী। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং এল নিনোর জেরে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, মনুষ্যঘটিত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই হিমবাহ শূন্য হল ভেনিজুয়েলা। আলেহান্দ্রো জানিয়েছেন, যে গতিতে Humboldt হিমবাহটি গলে গেল, তা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই ঘটল। উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যত উবে গেল হিমবাহটি।
শুধুমাত্র ভেনিজুয়েলাই নয়, আগামী দিনে একাধিক দেশ এই সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের। তাঁরা জানিয়েছেন, ২১০০ সাল আসতে আসতে পৃথিবীর ৮০ শতাংশ হিমবাহই কার্যত গায়েব হয়ে যাবে। তবে যে গতিতে Humboldt হিমবাহটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, সেই নিরিখে আরও আগে বিপদ নেমে এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মত তাঁদের। ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার ভূবিজ্ঞানী, গবেষক ম্যাক্সিমিলানো বেজাডা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটছে। এর ফলে আন্টার্কটিকা-সহ পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার হিমবাহগুলি যেমন এক এক করে গলে যাচ্ছে, তেমনই সমুদ্রের জলস্তরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে।