সন্দীপ সরকার, কলকাতা: 'পছন্দের দল করলে হবে না। প্রয়োজনের দল গড়তে হবে...', গাড়িতে ওঠার আগে বলে গেলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলার (Bengal Ranji Team) এক সিনিয়র ক্রিকেটার।


বঙ্গ টিম ম্যানেজমেন্টের আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইডেন (Eden Gardens) ছেড়ে বেরনোর সময় বলে গেলেন, 'বাড়ি গিয়ে একটু খাব। সকাল থেকে কিছু খাইনি। পরাজয়ের পর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আসলে গায়ের চামড়াটা এখনও পাতলা তো...।'


রঞ্জি ট্রফিতে (Ranji Trophy) ফের ফাইনালে বিপর্যয় বাংলার। ফের তীরে এসে তরী ডোবার চর্বিত চর্বণ। ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪.... বছরের পর বছর। অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। রঞ্জি ট্রফি আর বাংলার মধ্যে কাপ ও ঠোঁটের ব্যবধান ঘুচছে না। নিজেদের ঘরের মাঠে সৌরাষ্ট্রের কাছে ৯ উইকেটে হারের ধাক্কায় তছনছ বঙ্গ শিবির। যে হারের কারণ অনুসন্ধান করতে বসে উঠে আসছে একাধিক তেঁতো প্রসঙ্গ।


কেন রঞ্জি ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে বত্রিশের সুমন্ত গুপ্তর অভিষেক ঘটানো হবে? কেন এমন একজনকে দিয়ে ইনিংস ওপেন করানো হবে, যিনি ক্লাব ক্রিকেটেও কখনও ওপেন করেননি? কেন চতুর্থ পেসার হিসাবে এমন কাউকে খেলানো হবে, যাঁকে গোটা ম্যাচে ৭ ওভারের বেশি বল করানো যাবে না? এমনকী, ফিল্ডিংয়েও যাঁকে লুকিয়ে রাখার মতো অবস্থা! অভিমন্যু ঈশ্বরণ আর কবে নক আউট পর্বে রান করবেন? আকাশ ঘটক থেকে শুরু করে অভিষেক পোড়েল, হঠকারী শট খেলে আউট হওয়ার বদভ্যাস কবে বন্ধ হবে বাংলার ক্রিকেটারদের? দেরিতে প্র্যাক্টিসে এলে, ম্যাচে নো বল করলে ক্রিকেটার, সাপোর্ট স্টাফদের আর্থিক জরিমানা করেন বাংলার কোচ। হেডস্যার লক্ষ্মীরতন কি এবার খারাপ শট দেখলে বা মাঠে কারও শরীরী ভাষায় নেতিবাচকতা দেখলেও কঠোর হবেন?


ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের কাছে পরাজয়ের ময়নাতদন্তে বসে অবধারিতভাবে উঠে আসছে একের পর এক প্রশ্ন। উত্তর হাতড়াচ্ছেন বাংলার কোচ, অধিনায়ক। প্রকাশ্যে ক্রিকেটারদের পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। তবে আড়ালে আবডালে হতাশাও গোপন করতে পারছেন না পুরোপুরি।


অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি যেমন বলছেন, 'ট্রফির এত কাছে এসে হারলে ক্রিকেটারদের থেকে বেশি দুঃখ কেউ পায় না। তবে এটাই জীবন। অনেক সময় কাছে এসেও লক্ষ্যপূরণ হয় না। কাছ থেকে দেখেও ট্রফিটা হাতে তুলতে পারলাম না।' তারপরই যোগ করছেন, 'হারলে সিদ্ধান্তগুলো কেন ব্যর্থ হল, ভাবতে হয়। আমরা সুমন্তকে খেলিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই পরিস্থিতিতে রান পাবে। পারেনি। সুমন্ত এই ম্যাচে অভিষেক ঘটিয়েছে। ওকে একটু ছাড় দেওয়া যেতে পারে। তবে রান পায়নি। ভাল বলে আউট হয়েছে। আকাশ ঘটক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কেউ নিজের দক্ষতা অনুযায়ী খেলতে না পারলে সেটা মানসিকতার সমস্যা। কোচ ও ক্যাপ্টেন আর কী করবে!'


সুমন্তকে দিয়ে ওপেন করানো নিয়ে মনোজের যুক্তি, 'যারা বাংলা দলে আসে, তাদের ক্লাব ক্রিকেটে পারফরম্যান্স, ধারাবাহিকতা দেখা হয়। সুমন্তর ওপেন করার কথা ছিল না। ওপেনিংয়ে যাদের সুযোগ দিয়েছি, তারা কেউ পারেনি। ফাইনালে বাইরে থেকে এনে কাউকে খেলালে তার ওপর চাপ হতো।' তা বলে ৩২ বছরের কারও ওপর লগ্নি কেন? মনোজের অদ্ভুত যুক্তি, '৩০ বছর বয়সের পর থেকে খেলা খুলে যায়।'


মনোজের কথা শুনে অনেকে হতবাক। কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, বঙ্গ অধিনায়ক কি আধুনিক ক্রিকেটের খবর রাখেন না? জাতীয় দলে যেখানে তরুণ তুর্কি শুভমন গিল, ঈশান কিষাণকে বিভিন্ন ফর্ম্যাটে ওপেনার হিসাবে সুযোগ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে বত্রিশের কারও ওপর লগ্নি করা কি শুধু প্রিয় পাত্রকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য!


বাংলার ক্রিকেট দল নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর নেন, একটি তথ্য শুনলে তাঁরা চমকে উঠতে পারেন। বাংলা দলের একাধিক ক্রিকেটারের নিজস্ব ক্রিকেট অ্যাকাডেমি রয়েছে। যেখানে উঠতিদের ক্রিকেট পাঠ দেওয়া হয়। এমনকী, ফাইনালে দুই ইনিংসে ১ ও ১ করে মোট ২ রান করা ক্রিকেটার সুমন্ত গুপ্তরও রামপুরহাটে অ্যাকাডেমি রয়েছে। দেহরাদূনে অভিমন্যু ঈশ্বরণের নামে আস্ত একটা স্টেডিয়াম রয়েছে। আকাশ দীপের নিজস্ব অ্যাকাডেমি রয়েছে। যা শুনে অনেকে হতবাক। বলা হচ্ছে, যাঁরা নিজেরাই মাঠে ট্রফির হদিশ পাচ্ছেন না, বড় ম্যাচে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন, তাঁরা তরুণ প্রজন্মকে কী শেখাবেন!


অভিমন্যু ঈশ্বরণ বাংলাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় দলে ডাক না পেলে এই মরসুমেও তিনিই নেতৃত্ব দিতেন। অথচ নক আউট পর্বে বরাবর ব্যর্থ। মরণ-বাঁচন পরিস্থিতিতে আর কবে রান করবেন অভিমন্যু? মনোজও উত্তর হাতড়াচ্ছেন। বলছেন, 'এটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলব। ফাইনালের আগে ব্যাটিং করতে গিয়ে কী চিন্তাভাবনা করছিল জানতে হবে। আমরা ওদের যাই বলি না কেন, ওরা কী ভেবে মাঠে নামছিল জানতে হবে। সকলকে উৎসাহ দেওয়া হয়। অন্য কোনও রাজ্য দল তাদের ক্রিকেটারদের এত উৎসাহ দেয় বলে মনে হয় না। ওদের দায়িত্ব নিতে হবে। যেদিন সেটা পারবে, ওরা পরের পর্বে পৌঁছে যাবে।'


বাংলা শিবির থেকে বলা হচ্ছে, টস ফ্যাক্টর হয়েছে। প্রথম দিন পিচে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব ছিল। যার ফায়দা পেয়েছেন সৌরাষ্ট্রের পেসাররা। পাল্টা প্রশ্নও উঠছে। বলা হচ্ছে, পিচে কয়েক ঘণ্টায় এমন কী পরিবর্তন হয়ে গেল যে, বাংলার পেসাররা নখদন্তহীন হয়ে পড়লেন? প্রথম ইনিংসে বাংলার ব্যাটিং বিপর্যয় না হয় তরতাজা সবুজ পিচের জন্য, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যর্থতার কারণ কী? প্রথম ইনিংসে আকাশ দীপ বা দ্বিতীয় ইনিংসে অভিষেক পোড়েলের উইকেট ছুড়ে দেওয়ার ব্যাখ্যাই বা কী?


মনোজ যদিও বলছেন, 'আমাদের ক্রিকেটারদের মানসিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। দল নিয়ে আমি গর্বিত। ড্রেসিংরুমে কান্নাকাটি করছে ছেলেরা। আবেগ ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না।' যোগ করছেন, 'গোটা মরসুমে এক জায়গায় বল করে সাফল্য পেয়েছে আমাদের বোলাররা। ফাইনালে তুলেছিল এই বোলিং। ফাইনালে ওরা পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারেনি।'


কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল বলছেন, 'আমি কোচ হয়ে আসার পর স্থানীয় ক্রিকেটে সফল সকলকে সুযোগ দিতে চেয়েছি। সুমন্ত-আকাশরা স্থানীয় ক্রিকেটে পারফর্ম করেছে। তাই সুযোগ পেয়েছে।' বাংলা কোচের উদ্দেশেও কোনও কোনও মহল থেকে অপ্রীতিকর প্রশ্ন উঠে পড়ছে। বলা হচ্ছে, যদি নতুন মুখে ভরসা করতেই হয়, তাহলে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে তাঁকে দিয়ে ওপেন করানো হল না কেন? কেন ওই দুই ম্যাচে দুজন আলাদা আলাদা ক্রিকেটারকে খেলানো হল ওপেনার হিসাবে? প্রত্যেক ম্যাচে ওপেনার বদলে কি ক্রিকেটারদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে না? এক প্রাক্তন ক্রিকেটার তো এ-ও বলে দিলেন যে, ওরা ব্যাট করবে কী, ভাবছে পরের ম্যাচেই না বাদ পড়ে যাই। সেই চাপে পড়েই মানসিকভাবে দুমড়ে যাচ্ছে।


দিনের শেষে হাতে থাকা পেন্সিলের মতো শুধু থাকছে অনুষ্টুপ মজুমদারের বুড়ো হাড়েও ভেল্কি। ফাইনালে চাপের মুখে অভিজ্ঞ মনোজের ব্য়াট হাতে লড়াই। যাঁরা এখনও উদাহরণ তৈরি করে চলেছেন। তরুণ প্রজন্ম তাঁদের দেখে শিখবে কবে? 


মরসুম শেষ। ফের নতুন মরসুমের প্রস্তুতি শুরু হবে। কিন্তু তার আগে কি নির্বাচকদের কানে পৌঁছবে সিনিয়র ক্রিকেটারের বলা কথাগুলো? যিনি বলছিলেন, 'পছন্দের দল করলে হবে না। প্রয়োজনের দল গড়তে হবে।'


আপাতত সেই আলোর খোঁজে বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীরা।



আরও পড়ুন: একপেশে ম্যাচের হুঙ্কার দিয়ে লজ্জার হার, রঞ্জি ফাইনালে আত্মসমর্পণ বাংলার