কলকাতা: 'পুরনো ছক, নতুন ফাঁদ', ডিজিট্যাল জালিয়াতির হাত থেকে শহরবাসীকে বাঁচাতে সচেতনতামূলক বার্তা দিল লালবাজার সাইবার থানা (Lalbazar Cyber Crime)। কীভাবে বুঝবেন যে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ? তা নিয়ে কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে বিস্তারিত বললেন ইনস্পেকটর শুক্লা সিনহা রায়। 



ময়দানে প্রতারকরা


গত কয়েক বছরে 'ব্যাঙ্কের থেকে বলছি' এমন ফোন অনেকেই পেয়েছেন। ক্ষণিকের ভুলে এটিএম কার্ডের (ATM Card) নাম্বার শেয়ার করতেই মুহূর্তেই অ্যাকাউন্ট ফাঁকা, এমন উদাহরণও কম নয়। মূলত খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই ধরণের প্রতারণা প্রধানত কোভিড পর্বের (Covid Situation) আগেই বেশি পরিমাণে হয়েছে। ইদানিংকালে তাহলে কি কমে গিয়েছে প্রতারণা বা ডিজিট্যাল জালিয়াতি ? আজ্ঞে না, আগের থেকেও ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে ময়দানে নেমেছে প্রতারকরা। 


'পুরনো ছক, নতুন ফাঁদ'


বিখ্যাত মার্কিন ব্যবসায়ী তথা বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট যেমন শেয়ারের ক্ষেত্রে একটা বড় উদাহরণ রেখেছিলেন। মানুষ জেনেছে যে, দেশে যখন যুদ্ধ লাগে, তখন যুদ্ধের অস্ত্রের কোম্পানিতে নিয়োগ হলে, শেয়ারে অনেক বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই তত্ত্বের সঙ্গে প্রতারকের ছকের প্রসঙ্গ আসছে কেন ? আসছে কারণ প্রতারকরাও ঠিক সেই ক্রাইসিসটাই খুঁজে বার করেছে। যা কোভিড পর্বে বেশি করে তৈরি হয়েছে। তা হল বহু মানুষের চাকরি গিয়েছে। অতয়েব পেট চালাতে চাকরি তো চাই। আর ঠিক এই জায়গাতেই গোল হাঁকিয়েছে ডিজিট্যাল জালিয়াতির দল।


ওয়ার্ক ফর্ম হোম


ঘরে বসে আয় বা 'ওয়ার্ক ফর্ম হোম' কালচার আগেও ছিল, কিন্তু কোভিডের পরে তা বেশি পরিচিতি পেয়েছে বঙ্গে তথা সারা দেশে। আর ঠিক এই জায়গাতেই হুল ফুটিয়েছে প্রতারকরা। বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম যেমন হোয়্যাটসঅ্যাপের মাধ্যমে ঘরে বসে অর্থাৎ 'ওয়ার্ক ফর্ম হোম' অনলাইন চাকরির অফার আসছে। আর তা পুরোটা যাচাই করার আগেই, সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে বেকার ছেলে মেয়েরা। এখানে সবচেয়ে বড় কথা, প্রথম দিকে এখানে টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হলেও, পরে এমন একটা মুহূর্ত আসছে, যেখানে আপনাকে অফার দেওয়া হচ্ছে বিনিয়োগের। অর্থাৎ অল্প বিনিয়োগ করুন, বেশি করে মুনাফা নিন। এখানেই শেষ নয়, আপনি সেই মুনাফাও পাবেন অ্যাকাউন্টে। এবং আপনার এই ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট পুরোটাই ওই ডিজিট্যাল জালিয়াতির দল করে দেবে। কিন্তু একটা সময় বিনিয়োগের পরিমাণ এতটাই বাড়বে, যে আপনি, বেশি মুনাফার আশায় যেই না বাধ্য হবেন বিনিয়োগে, অমনি যবনিকা পতন।


কীভাবে বুঝবেন যে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ?


ইনস্পেকটর শুক্লা সিনহা রায় ভিডিওটি মন দিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, 'ইদানিং একটি নতুন ধরণের জালিয়াতির শিকার হচ্ছেন অনেকেই। ইউটিউব এবং টেলিগ্রাম। এই দুই মাধ্যমের অপব্যবহার।' কলকাতা পুলিশের তরফে তিনি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, 'অজানা নম্বর থেকে অযাচিত হোয়াটসঅ্যাপে কেউ রোজগারের অফার দিলে সতর্ক থাকুন। বিনা পরিশ্রমে বা অতি অল্প পরিশ্রমে মোটা টাকা রোজগার অসম্ভব, সেকথা মাথায় রাখুন। সুতরাং ইউটিউব ভিডিও-তে লাইক দিলেই আপনার ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকে যাবে। এই প্রস্তাব যে বড় রকমের জালিয়াতির সূত্রপাত, তা ধরেই নিন', এই সতর্কবার্তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতেও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।


ধাপে ধাপে সর্বনাশ


প্রসঙ্গত, কলকাতা পুলিশের (Kolkata Police) তরফে জানা গিয়েছে, কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। লেক রোডের এক বাসিন্দার কাছে অনলাইন, পার্ট টাইম কাজ সংক্রান্ত একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আসে। অচেনা নাম্বার থেকে। সঙ্গে দুটি ইউটিউব ভিডিও লিঙ্ক। যেদুটিতে লাইক দিলেই তাঁকে দেওয়া হবে ১০০ টাকা। অর্থাৎ লাইক পিছু ৫০ টাকা। বলা হয় এটাই তাঁর 'টাস্ক।' নির্দেশ মতো দুটি ভিডিওতে লাইক দিয়ে প্রমাণ-সহ স্ক্রিন শট পাঠিয়ে দেন অভিযোগকারী। তাঁকে যে মেসেজ করেছিল সেই ব্যাক্তি এবার , তাঁর অ্যাকাউন্ট নাম্বার চেয়ে নিয়ে সেখানে ১০০ টাকা যোগ করে দেয়। এর পর তাঁকে বলা হয় টেলিগ্রামে ক্যারিয়ার বিল্ডার্স নামের একটি গ্রুপে জয়েন করতে। যেখান থেকে তাঁর সঙ্গে এক ব্যাক্তি যোগাযোগ করে জানায়, 'টরাস' নামক 'ক্রিপ্টো ট্রেডিং' অ্যাপে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে তাঁকে।  


জালিয়াতির গন্ধ


ক্রিপ্টোতে প্রথমে ১০০০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে বলা হয়। এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, এর ওপর তিনি ৩০ শতাংশ কমিশন পাবেন। বাস্তবিক মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে যায় ১৩০০ টাকা। এরপর এভাবেই অল্প পরিমাণ টাকা আরও একাধিক বার তিনি বিনিয়োগ করেন। প্রতিবারই তিনি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারে ফেরতও পেয়ে যান তিনি। আর এভাবেই প্রতিবারেই একটু একটু করে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এভাবেই একবার ৩০ হাজার টাকা জমা করতে বলা হয় তাঁকে। কিন্তু এবার আর কিছু ফেরৎ আসে না। এবার আরও তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে, আগের সমস্ত টাকা ফেরৎ এসে যাবে। কিন্তু এবারেও নিটফল শূন্য। এখানেই শেষ নয়, এবার দাবি আসে ১০ লাখ টাকার।এটা দিলে আকাশ ছোঁয়া কমিশনের পাশাপাশি তিনি আগের সব টাকা ফেরতও পেয়ে যাবেন। যদিও এবার তিনি জালিয়াতির গন্ধ পেয়ে টাকা দিতে অস্বীকার করেন।


আরও পড়ুন, সাঁতারে কী কী রোগ থেকে মুক্তি ? কী বলছেন চিকিৎসক ?


আরও পড়ুন, জানেন কি রান্নাঘরের এই মশলা জীবন বদলে দিতে পারে ? 


কলকাতা পুলিশের বড় সাফল্য


মোট ৪.৮০ লাখ টাকা খুইয়ে সাউথ ইস্ট ডিভিশনের সাইবার শাখায় অভিযোগ জানান তিনি।এবং তদন্তে নেমে সার্জেন্ট রাহুল বোস প্রথমেই দ্রুত 'ফ্রিজ' করিয়ে দিতে সক্ষম হন, সেই সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, যেগুলিতে মূলত টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন অভিযোগকারী। রাহুলের রিপোর্টের ভিত্তিতে এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কগুলিকে আদালত নির্দেশ দেন, এই সব অ্যাকাউন্ট থেকে ফিরিয়ে দিতে হবে, অভিযোগকারীর খোয়া যাওয়া ওই টাকা। যার ফলে বর্তমানে ৩.৭৫ লাখ টাকা ফেরৎ এসে গিয়েছে তাঁর কাছে। পুরো ঘটনার উদাহরণ টেনে সকলেই সতর্ক থাকতে বলেছে কলকাতা পুলিশ।