গিরীশকুমার নায়ার: সাধারণ মানুষ থেকে তারকা, ইদানীং কালে হৃদরোগে (Heart Attack) আক্রান্ত হওয়া এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত বছর এই সেপ্টেম্বর মাসেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লা। তাতে গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার পরও একাধিক এমন ঘটনা সামনে এসে। জনপ্রিয় শিল্পী কেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। সম্প্রতি ২০ বছরের এক তরুণী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরই মধ্যে মহারাষ্ট্রে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত চিকিৎসকের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন এক রোগী।


অর্থাৎ বয়স ২০ হোক বা ৪০, অথবা ৫০, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা নিত্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানীং কালে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর ‘ওয়র্ল্ড হার্ট ডে’, অর্থাৎ হৃদযন্ত্র সুস্থতা পালন দিবস (World Heart Day 2022)।। তার আগে হৃদরোগের এই বাড়-বাড়ন্তের কারণ কী, তা বিশদে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।  


হৃদরোগ কী


চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় হৃদরোগকে বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।


হৃদরোগের কারণ



  • সচল থাকতে গোটা শরীরের মতো হৃদযন্ত্রেরও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।

  • করোনারি ধমনী হৃদযন্ত্রে ওই অক্সিজেন সরবরাহ করে।

  • কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অনিয়মিত জীবনযাপনে করোনারি ধমনীর ভিতরের দেওয়ালে ফ্যাট জমে যায়।

  • এর ফলে সময়ের সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

  • ফুসফুসে রক্তের সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

  • এর ফলে কার্ডিয়াক ইস্কেমিয়ার পরিস্থতি তৈরি হয়, যাতে হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।

  • বেশ কিছু সময় পর্যন্ত বুঝতে না পারলে, বা চিকিৎসায় দেরি হলে হৃদযন্ত্রের কোষগুলির একে একে মৃত্যু ঘটে। তাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন মানুষ।


উপসর্গগুলি কী কী



  • বুকে চাপ অনুভব করা, যন্ত্রণা, শ্বাস নিতে সমস্যা, আঁটোসাটো বোধ করা

  • বুকের যন্ত্রণা কাঁধ, হাত, ঘাড়, চোয়াল, দাঁত এমনকি কখনও কখনও পেটের উপরের অংশেও ছড়িয়ে পড়ে।

  • ঘামতে শুরু করেন আক্রান্ত ব্যক্তি।

  • ক্লান্ত এবং অবসন্ন বোধ করেন রোগী

  • বুকজ্বালা, বদহজম

  • হালকা মাথাব্যথা, আচমকা মাথাঘোরা

  • বমি বমি ভাব

  • শ্বাসকষ্ট

  • মহিলাদের ক্ষেত্রে ঘাড়ে, হাতে, পিঠে এবং চোয়ালে চিনচিনে ব্যথা

  • কিছু ক্ষেত্রে আচমকা বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়


সঙ্গে সঙ্গে কী করা উচিত



  • অবশ্যই অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত রোগীকে। তার আগে অ্যাসপিরিন দিতে পারেন (300mg)। তবে খেয়াল রাখবেন, রোগীর যেন অ্যাসপিরিনে অ্যালার্জি না থাকে।

  • অ্যাসপিরিন খেলে রক্ত পাতলা হয়ে যায় ফলে ফুসফুসে রক্তের সঞ্চালন অব্যাহত থাকে।


হৃদরোগ এড়াতে কী করবেন



  • জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত।

  • ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করুন।

  • কোলেস্টরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

  • স্থূলতা থাকলে আগে ওজন ঝরানো প্রয়োজন।

  • প্রতিদিন শরীরচর্চা জরুরি। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করতেই হবে।

  • কম ফ্যাটযুক্ত, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার খান। গোটা শস্যদানা, ফল, শাক-সবজি পাতে রাখুন রোজ।

  • মদ্যপানের অভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

  • নিয়মিত নজর রাখুন রক্তচাপ এবং সুগারের মাত্রায়।

  • দুশ্চিন্তা কমাতে হবে।


ঝুঁকি রয়েছে যাঁদের



  • নিয়মিত চিকিৎসকদের পরামর্শ নিন। সময়ে সময়ে চেকআপ করান।

  • চিকিৎসক যেমন বলবেন, সময়ে সময়ে ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, অ্যাঞ্জিওগ্রাম, রক্তপরীক্ষা, কার্ডিয়াক সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান এবং স্ট্রেস টেস্ট করাতে হবে।


কার্ডিয়াং অ্যারেস্ট (Cardiac Arrest)



  • হৃদযন্ত্র আচমকা বিকল হয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট, চৈতন্য হারানোর সম্ভাবনা।

  • হৃদযন্ত্র বিকল হলে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়।

  • হৃদরোগ এবং কার্ডিয়াং অ্যারেস্ট আলাদা।

  • তবে হৃদরোগের ফলেও হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে কার্ডিয়াং অ্যারেস্ট হতে পারে।

  • সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা না হলে মৃত্যু হতে পারে।

  • দ্রুত চিকিৎসা করানো গেলেই তবেই বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব রোগীকে।

  • সঙ্গে সঙ্গে সিপিআর দেওয়া গেলে, বুকের উপর দু’হাত দিয়ে চেপে সিপিআর দিলেও কাজ হয়।

  • সাধারণত কোনও আগাম ইঙ্গিত ছাড়াই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ঘটে।


উপসর্গ



  • আচমকা অবসন্ন হয়ে পড়া, পড়ে যাওয়া

  • নাড়ির স্পন্দন পাওয়া না গেলে

  • শ্বাসবন্ধ হয়ে যাওয়া

  • জ্ঞান হারানো


২০২০ সালে দেশে হৃদরোহে আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ৬৮০ জনের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে সংখ্যাটা সামান্য কমেছে, ২৮ হাজার ৪৪৯। ২০১৯ সালে যদিও সংখ্যাটা ছিল ২৮ হাজার ৫। ঠিক এক দশক আগে, ২০১২ সালে দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ হাজার ৫২২ জনের মৃত্যু হয়।


তবে করোনা কালে টিকা নেওয়ার কারণে মৃত্যু কিছুটা কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশে টিকাকরণ শুরু হয়।মানুষও অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। তার জন্যই হৃদরোগজনিত মৃত্যু কমে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


বয়সের নিরিখে ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সিদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি, ৩৯.৩ শতাংশ। মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের মধ্যে। ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ২১ শতাংশ। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে ৮.৯ শতাংশ হার মৃত্যুর। ১৪ থেকে ১৮ বছর এবং অনূর্ধ্ব ১৪ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার যথাক্রমে ০.৪ এবং ০.২ শতাংশ।


এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শারীরিক পরিশ্রম বেশি, দুশ্চিন্তা বেশি বলেই ৩০ থেকে ৩৫ এবং ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সিদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। ষাটোর্ধ্বরা এমনিতেই বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।


আরও পড়ুন: Health Tips: খালি পেটে যে ৫ খাবার খেলে শরীর খারাপ হতে পারে