তেহরান: অন্যায় দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হতে পেরে গর্ববোধ করেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনে বারং বার প্রশ্নের মুখে পড়েছেন নিজেই। গণহত্যায় নাম জড়িয়েছে তাঁর। নারীর স্বাধীনতার হরণের অভিযোগ উঠেছে। সমকামিতাকে বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করছেন নির্দ্বিধায়। বিতর্ককে সঙ্গী করেই রাজনীতিক হিসেবে জীবনের ৬০টি বসন্ত পার করে ফেলেছিলেন। আয়াতোল্লা আলি খামেইনির পর ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ শাসক হওয়ার দৌড়েও ছিলেম ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি। কিন্তু হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ৬৩ বছর বয়সে প্রাণ হারালেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে আরব দুনিয়া-সহ ইরানের বন্ধু দেশগুলি যদিও সমবেদনা জানিয়েছে, কিন্তু দেশের অন্দর থেকে ভিন্ন ছবিও উঠে এসেছে। রবিবার রইসির হেলিকপ্টার ভেঙে পড়েছে বলে খবর আসতেই, বেশ কিছু জায়গায় আতস বাজি পোড়ানোর দৃশ্য ধরা পড়ে। মৃত্যুর পরও তাই ইরানের রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র হয়েই রইলেন রইসি। কারণ নিছক দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র, হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে তাঁর মৃত্যু নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। (Ebrahim Raisi Demise)


১৯৬০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পয়গম্বর মহম্মদের বংশধরের ঘরে জন্ম রইসির। বাবা সৈয়দ হাজি ছিলেন আলেম। রইসির যখন পাঁচ বছর বয়, মারা যান সৈয়দ। শিয়া পণ্ডিতদের জন্য নির্ধারিত হাওজায় শিক্ষালাভ করেন। পরবর্তীতে আয়াতোল্লা বোরোউজের্দি স্কুলে ভর্তি হন। নাগরিক আইনে ডক্টরেট অর্জন করেছেন বলে যদিও দাবি করতেন রইসি, কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আয়াতোল্লার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে দেশের অন্দরেও। শোনা যায়, একসময় নিজেই নিজেকে ‘আয়াতোল্লা’ বলে উল্লেখ করতে শুরু করেন রইসি। পরবর্তীতে আয়াতেল্লার ঠিক নীচের স্থান, হোজাত-ওল-ইসলাম পদে নিজেই নিজেকে বসান। (Ebrahim Raisi Profile)


১৯৮১ সালে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কর্মজীবনে পা রাখেন রইসি। ১৯৮৫ সালে রাজদানী তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর পদে উন্নীত হন। ১৯৮৮ সালে, ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতোল্লা রুহোল্লা খোমেইনির সুনজরে পড়েন রইসি। এর পর বিচার ব্যবস্থার বাইরে, স্বাধীন ভাবে কিছু প্রদেশের আইন-কানুনের দায়িত্ব পান। সেই থেকেই ইরানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন রইসি। নাম জড়ায় ১৯৮৮ সালের গণহত্যায়। ইরানে সেই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। সরকার বিরোধী পিপলস মুজাহিদিন অফ ইরানের সমর্থক রাজনৈতিক বন্দিদের কচুকাটা করার অভিযোগ ওঠে। বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন ফিদায়েঁ এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইরানের সমর্থকদেরও নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় বলে সামনে আসে। রাজতন্ত্র হটিয়ে ইরানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পিপলস মুজাহিদিন অফ ইরানের। পরবর্তীতে শাসনব্যবস্থায় মৌলানা, আলেমদের প্রভাবের বিরুদ্ধে সরব হয় তারা। ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, নারীবাদ এবং শ্রেণিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করে। তাতেই একদা বন্ধু খোমেইনি, মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে চটে যান এবং তার ফলস্বরূপই গণহত্যা চালানো হয় বলে অভিযোগ।


আরও পড়ুন: Ebrahim Raisi Killed: হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট, জোরাল হচ্ছে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বও, অশান্তির আশঙ্কা


ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর পর, দেশের ৩২টি শহরে এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চলে বলে সেই সময় খবরে ছেয়ে যায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। সবমিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানোর খবরও সামনে আসে। কোনও রকম আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া, সকলকে খুন করা হয় এবং দীর্ঘ দিন বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয় বলে জানা যায়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ওই ঘটনাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে ইরানের সবচেয়ে বড় অপরাধ’ বলে উল্লেখ করে আজও। রইসি গণহত্যার অন্যতম মূল চরিত্র ছিলেন বলে দাবি করেন ইরানে ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হুসেন আলি মনতাজেরি। মোর্তাজা এশরাঘি, হোসেন আলি নায়েরি, মোস্তাফা পুরমহম্মদির নামও উল্লেখ করেন হুসেন আলি। ওই চারজনকে নিয়ে ‘ডেথ কমিটি’ গঠিত হয়েছিল, যার নির্দেশে রাজনৈতিক বন্দিদের কচুকাটা করা হতো বলে জানান তিনি। বাকিরা সরাসরি নিজেদের ভূমিকা অস্বীকার করলেও, রইসি কখনও গণহত্যায় যুক্ত থাকার কথা সরাসরি অস্বীকার করেননি।


১৯৮৮ সালের গণহত্যায় তাঁর নাম যে বার বার উঠে এসেছে, সেই নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে ২০১৮ সালে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন রইসি। তবে অভিযোগ অস্বীকার না করে আত্মপক্ষ সমপ্থনে নামেন তিনি। জানান, মুজাহিদিনকে ঠেকাতে কড়া পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “তেহরানে সেই সময় দিনে বিপ্লবী বাহিনীর ১০০ থেকে ১২০ জন করে খুন হচ্ছিলেন। আমি এই কপটতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরে সম্মানিত বোধ করি।” কিন্তু আজও ‘Butcher of Tehran’, অর্থাৎ ‘তেহরানের কসাই’ হিসেবেই রইসিকে উল্লেখ করেন তাঁর সমালোচকরা।


খোমেইনির মৃত্যুর পর ইরানের সর্বোচ্চ শাসক নির্বাচিত হন আলি খামেনেই। সেই সময় তেহরানের সরকারি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন রইসি। ১৯৯৪ সালে ইরানের পর্যবেক্ষক বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। আয়াতোল্লার নির্দেশ কার্যকর করতে যে Setad সংগঠন রয়েছে, টানা ১০ বছর তার বোর্ডের সদস্য ছিলেন রইসি। ২০১৭ সালে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইসলামিক রেভলিউশন ফোর্সেস রইসিকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ঘোষণা করে। ফ্রন্ট অফ ইসলামিক রেভলিউশন স্টেবিলিটিও রইসিকে সমর্থন করে। কিন্তু তদানীন্তন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন রইসি। বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাননি তিনি, বরং নির্বাচনের সময় কোথায় কী অনিয়ম হয়েছে, তা নিয়ে তদন্তের দাবি জানান। ২০১৯ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় আমেরিকা। গণহত্যায় তাঁর ভূমিকা বিবেচনা করে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং একাধিক মানবাধিকার সংগঠন রইসিকে গ্রেফতারির দাবিও জানায়।


আরও পড়ুন: Mohammad Mokhber: নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল আমেরিকা ও ইউরোপ, আয়াতোল্লা ঘনিষ্ঠই ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট


২০২১ সালে ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাম লেখান রইসি। সেবার ৬৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। কিন্তু এই জয়ও ছিল বিতর্কিত। প্রায় ৩৭ লক্ষ ভোট গোনাই হয়নি। সেগুলিকে ‘অবৈধ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। আয়াতোল্লা ঘনিষ্ঠ রইসিকে প্রেসিডেন্ট করতে বহু প্রার্থীকে নাম তুলে নিতেও বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালের ১৫ অগাস্ট আবারও তালিবান আফগানিস্তান দখল করলে, রইসি আমেরিকার বিরুদ্ধেই মুখ খোলেন। আমেরিকা সেখান থেকে সরলেই আফগানিস্তানে শান্তি ফিরবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতেও মুখ খোলেন তিনি। হিটলারের আমলে আদৌ ইহুদিদের গণহত্যা হয়েছিল কি না প্রশ্ন তোলেন তিনি। রাশিয়া-ইরান যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলান রইসি। ২০২৩ সালে চিন সফরে গিয়ে সহযোগিতা চুক্তি সারেন। গত বছর অক্টোবরে নতুন করে ইজরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে, ইজরায়েলের বিলুপ্তি কামনা করেন রইসি।


কট্টরপন্থী, মৌলবাদী আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিক হিসেবেই পরিচিতি গড়ে ওঠে রইসির। কর্মক্ষেত্রে এবং জনসমক্ষে নারী-পুরুষের আলাপচারিতা নিষিদ্ধ করে ইরান সরকার। কারণ জানতে চাইলে রইসি জানান, এতে মহিলাদেরই লাভ। এতে মানুষের সেবায় মন দিতে পারবেন সকলে। মেয়েদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত যাতে ঢাকা থাকে, তার জন্য হিজাব পরার নিয়মকানুন এবং নিয়ম লঙ্ঘনের শাস্তিকে আরও কঠোর করে রইসির সরকার। ২০২২ সালে হিজাম ‘সঠিক ভাবে’ না পরার অভিযোগে তরুণী মেহসা আমিনিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এর পর দেশ জুড়ে রইসি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়। সেই আন্দোলনকে কমন করতে নির্বিচারে গুলি চালানো এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অভিযোগও ওঠে। সমকামিতা নিয়েও কট্টর অবস্থান ছিল রইসির। সমকামী সম্পর্ককে ‘বর্বরতা’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।