নয়াদিল্লি: বার্ধক্যকালে কথা জড়িয়ে আসে, ভুল বকার বিকারও গ্রাস করে আমাদের। কিন্তু মানুষ এবং যন্ত্র কখনও এক নয়। তাই মানুষের মতো যন্ত্রকে বিকারগ্রস্ত হতে দেখলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে মহাশূন্যে বিরাজমান ভয়েজার-১ (Voyager 1) মহাকাশযানকে নিয়ে বর্তমানে উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা। মানুষের মতোই ভয়েজার-১ মহাকাশযানও বার্ধক্যসুলভ আচরণ করছে, এমনকি অর্থহীন কথাবার্তা বলছে বলে অভিযোগ। (NASA VOYAGER 1 Mission)
১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাসে ভয়েজার-১ মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA. সৌরজগতের একেবারের কিনারায় অবস্থিত গ্রহদের পর্যবেক্ষণ করতেই সেটির উৎক্ষেপণ হয়। সেই থেকে গত পাঁচ দশক ধরে মহাশূন্যে ছুটে চলেছে ভয়েজার-১ মহাকাশযান। ভয়েজার-১ প্রথম মহাকাশযান, যা পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে, আন্তঃনাক্ষত্রিক অবস্থানে পৌঁছতে সফল হয়। (Science News)
সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে গ্রহদের রক্ষা করে যে হেলিওস্ফিয়ার বলয়, তার বাইরে পদার্পণকারী প্রথম মহাকাশযান ভয়েজার-১। বৃহস্পতিকে ঘিরে থাকা বলয়ও তারই আবিষ্কার। পাশাপাশি, বৃহস্পতির দুই উপগ্রহ, শনির পাঁচটি উপগ্রহ এবং শনিকে ঘিরে থাকা G বলয়ও ভয়েজার-১ মহাকাশযানই আবিষ্কার করে। ১৯৭৭ সালের পর ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করে NASA.
অত্যন্ত কম জ্বালানি ব্যবহার করে ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ চারটি গ্রহের চারিদিকে বিচরণ করে NASA. বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনের পারস্পরিক বিন্যাস সম্পর্কেও বিশদ ধারণা জন্মায় তাদের পাঠানো তথ্য থেকেই। সেই কারণেই ভয়েজার-১ মহাকাশযাবকে ঘিরে বাড়তি আবেগ রয়েছে NASA-র বিজ্ঞানীদের মধ্যে। ভয়েজার-১ মহাকাশযান যে বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছে এবং ভুল বকতে শুরু করেছে, তা মেনে নিতে খানিকটা অসুবিধেই হচ্ছে তাদের।
NASA-র জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরির গবেষক সুজান ডোড বলেন, “সহজ করে বললে, ভয়েজার-১ মহাকাশযানের কথাবার্তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর।” NASA জানিয়েছে, বর্তমানে পৃথিবী থেকে ১৫০০ কোটি মাইল দূরে অবস্থান করছে ভয়েজার-১। ইতিমধ্যেই ভয়েজার-১ মহাকাশযানের বিয়ারিংগুলি খুলে পড়ে গিয়েছে। গত নভেম্বর মাস থেকে পৃথিবীতে যে তথ্য পাঠাচ্ছে সে, তার বেশিরভাগই বোধগম্য নয়। আবার কিছু তথ্য একেবারেই অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক এবং ভুল তথ্য। কথাবার্তা যথেষ্ট অসংলগ্নও।সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করা হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তাই ভয়েজার-১ মহাকাশযানের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে বলে মনে করছেন NASA-র বিজ্ঞানীরা।
১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভয়েজার-১ মহাকাশযানের উৎক্ষেপণ হয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই বছরই ২০ অগাস্ট উৎক্ষেপণ হয় ভয়েজার-২ মহাকাশযানের, ক্রমান্বয় অনুযায়ী পিছিয়ে থাকলেও, ভয়েজার-১ মহাকাশযানের আগে পৃথিবী থেকে রওনা দেয় ভয়েজার-২। কিন্তু গন্তব্যে আগে পৌঁছয় ভয়েজার-১। ১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ বৃহস্পতিতে পৌঁছে যায় সে, ১৯৮০ সালের ১২ নভেম্বর শনিতে। সেই নিরিখে ভয়েজার-২ মহাকাশযান ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই এবং ১৯৮১ সালের ২৫ অগাস্ট শনিতে পৌঁছয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে দুই মহাকাশযানের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু একের পর এক সাফল্যে NASA-র বিজ্ঞানীরা তাদের দিয়ে আরও দুই গ্রহে অভিযান চালানো সিদ্ধান্ত নেন, ইউরেনাস এবং নেপচুনে। NASA-র দাবি, শুধুমাত্র বৃহস্পতি এবং শনিতে গিয়ে অভিযান শেষ করা হলেও, প্রাপ্ত তথ্য থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আস্ত বই লিখে ফেলা সম্ভব ছিল। কিন্তু গত পাঁচ দশক ধরে ভয়েজার অভিযান থেকে যে সমস্ত তথ্য সামনে এসেছে, তা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সৌরজগৎকে আরও ভাল করে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে বার্ধক্যে পৌঁছে ধুঁকতে থাকলেও, ভয়েজার-১ মহাকাশযানকে নিয়ে এখনই আশা ছাড়তে নারাজ বিজ্ঞানীরা। আগামী কয়েক মাস ভয়েজার-১ মহাকাশযানকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা চলবে বলে জানিয়েছে NASA. সঞ্চিত প্লুটোনিয়ান থেকেই এযাবৎ শক্তির জোগান পেয়েছে ভয়েজার-১, তবে তা-ও শেষ হওয়ার পথে। বর্তমানে মহাশূন্যে ঠিক কোন পরিবেশে রটেছে সে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তাই ভয়েজার-১ মহাকাশযানকে সুস্থ করে তোলা মোটেই সহজ কাজ নয়। তবে হাল ছাড়তে নারাজ বিজ্ঞানীরা।