কলকাতা: আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব উল্টোই হয়। কিন্তু চোখের সামনে যদি উল্টে যায় গোটা পৃথিবীই! ডান-বাম ঠিক করা তো দূর, লেখাপত্রও সব যদি উল্টে যায়! দুঃস্বপ্ন তো বটেই, ভাবলেই কাঁটা দেয় গায়ে। সিনেমার পর্দায় এমন জগতের ঝলক দেখেছি আমরা। কিন্তু তই বলে বাস্তবে! গল্পকথা মনে হলেও, বাস্তবে ঠিক এমনিটাই ঘটেছিল (Science News)। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সবকিছু উল্টো দেখতে শুরু করেন তিনি, ঠিক আয়নায় দেখা প্রতিবিম্বের মতো। শুধু তাই নয়, বাড়িঘর, গাছপালা, আকাশ-মাটি সব উল্টে যায় (Medical Science)। 


১৯৩৮ সালের ঘটনা। স্পেনে তখন গৃহযুদ্ধ চরমে। সই সময় গুলিবিদ্ধ হন সে দেশের এক সৈনিক। মাথায় গুলি লাগে তাঁর। তবে ক্ষত তেমন গুরুতর ছিল না। তাই প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু তার পর থেকেই আয়নার প্রতিবিম্বের মতো, তিনি সবকিছু উল্টো দেখতে শুরু করেন। আবার খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে নীচের দিকে মাথা ঝুলিয়ে দিলে যেমন সব কিছু উল্টো দেখি, সে ভাবেই সবকিছু ধরা দেয় তাঁর চোখে।


গবেষণা করতে গিয়ে সম্প্রতি বহু পুরনো সেই ঘটনার প্রসঙ্গ উঠে আসে। সেই সময়কার নথিপত্র, ওই সৈনিকের মেডিক্যাল রিপোর্ট ঘেঁটে বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। ওই সৈনিককে 'পেশেন্ট M' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণার রিপোর্টে। গত ১ এপ্রিল 'নিউরোলজিয়া' জার্নালে সেটি প্রকাশিত হয়েছে। 


আরও পড়ুন: Health News : হার্ট অ্যাটাকের আগে শুধু শরীরেই নয়, চুলেও আসে এই পরিবর্তন


গবেষকরা জানিয়েছেন, ওই সৈনিকের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। গৃহযুদ্ধের সময় মাথায় গুলি লাগে তাঁর। মাথার খুলিতে ঢুকে, ধার ঘেঁষে বেরিয়েও যায় গুলিটি। ফলে ক্ষত তেমন গুরুতর ছিল না। ফলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন রয়েছে বেল সেই সময় মনে হয়নি চিকিৎসকদের। কিন্তু যখন সংজ্ঞা ফেরে ওই সৈনিকের, তখনই বোঝা যায়, কোথায় গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে। সবকিছু বাঁকা এবং উল্টো দেখতে শুরু করেন তিনি। 


স্পেনের গোডেলা মিলিটারি হেল্থ হাসপাতালে সেই সময় কর্মরত ছিলেন চিকিৎসক জাস্টো গঞ্জালো রডরিগেজ-লিল। 'পেশেন্ট M' নামে ওই সৈনিকের মেডিক্যাল রিপোর্ট লিখে রেখে যান তিনি। মস্তিষ্কের ক্ষত নিয়ে সেই সময় গবেষণা করছিলেন তিনি। চোখের সামনে আক্ষরিক অর্থেই সব ওলটপালট হতে দেখেন ওই সৈনিক। বই, দেওয়ালের লেখাও উল্টো হয়ে ধরা দেয় তাঁর চোখের সামনে। শুধু তাই নয়, কোনও রঙিন জিনিস যদি চোখের সামনে রেখে দেওয়া হতো, সে ক্ষেত্রে 'পেশেন্ট M' ওই বস্তু এবং তার গয়ে চাপানো রংকে পরস্পরের থেকে পৃথক ভাবে দেখতে পেতেন। কখনও কখনও একটি জিনিসকে দু'টি, কখনও আবার তিনটি দেখতেন।


নিজের রিপোর্টে জাস্টো রডরিগেজ-লিল লিখে গিয়েছেন, যে কোনও দিক থেকেই হাতঘড়ির সময় বলে দিতে পারতেন 'পেশেন্ট M'। সবকিছু উল্টো হয়ে ধরা দিলেও, গড়গড় করেই খবরের কাগজ পড়তে পারতেন 'পেশেন্ট M'। নিজের লেখা 'ব্রেন ডায়নামিকস' বইয়েও বিশদে সে কথা লিখে গিয়েছেন জাস্টো রডরিগেজ-লিল। তিনি জানিয়েছেন, জমিতে কৃষকদের কাজ করতে দেখেন 'পেশেন্ট M'। কিন্তু তাঁর চোখে ওই কৃষকদের শরীর একেবারে উল্টোনো অবস্থায় ধরা দিয়েছিল। 


আরও পড়ুন: Skin Care Tips: গরমকালেও রুক্ষ-শুষ্ক ত্বকের সমস্যা? কীভাবে মুক্তি পাবেন, রইল কিছু সমাধান


এমন বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন জাস্টো রডরিগেজ-লিল । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীরা ফারাক বুঝতে পারেন না বলে দাবি তাঁর। শুধু তাই নয়, যখন বুঝতে পারেন কী ঘটছে, সাময়িক বিভ্রম বলে কাটিয়ে দেন। রোজকার জীবনেও তেমন প্রভাব পড়ে না। জাস্টো রডরিগেজ-লিলের মতে, ক্ষত কতটা গভীর, তার অবস্থানন কোন খানে, ক্ষত বাইরে না ভিতরে, তার উপরই মস্তিষ্কের কতটা ক্ষতিগ্রস্ত, তা নির্ভর করে।


মস্তিষ্কে আঘাতের ক্ষেত্রে তিনটি লক্ষণকে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি, সেন্ট্রাল (যাতে একাধিক ইন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়), প্যারাসেন্ট্রাল (সব ইন্দ্রিয় সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না) এবং মার্জিনাল (একটি বা নির্দিষ্ট কয়েকটি ইন্দ্রিয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়)। কোনও রকম চিকিৎসা ছাড়াই 'পেশেন্ট M' গোটা জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। নয়ের দশকে মারা যান তিনি।